ভাবতে খুব অবাক লাগে যে একাত্তর সালের সেই অবিশ্বাস্য বিজয়ের দিনটির পর ৪৫ বছর কেটে গেছে। যখন ফিরে তাকাই মনে হয় মাত্র সেদিন বুঝি ছিল সেই বিজয়ের দিন।
আমাকে মাঝেমধ্যেই কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি, আমার কখনো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। সব সময়ই বলি, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। শুধু আমি নই, আমি নিশ্চিত আমার বয়সী যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছে তারা সবাই একই উত্তর দেবে। আমি সব সময়ই বলি, যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছে, তাদের জীবনটি পৃথিবীর যেকোনো মানুষের জীবন থেকে ভিন্ন একটি জীবন। এই জীবনে আমরা পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের পদলেহী অনুচরদের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা দেখেছি এবং সেটি দেখে আমাদের মানুষ নামের প্রজাতির ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু আমরা বিশ্বাস হারাইনি, মুক্তিযুদ্ধের সেই ৯ মাস এ দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর একজনের জন্য আরেকজনের যে ভালোবাসা দেখেছি, সেটি আমাদের সারা জীবনের জন্য পরিবর্তিত করে দিয়েছে। আমরা কখনো মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাই না। শুধু যে মানুষকে নতুন করে বিশ্বাস করতে শিখেছি তা নয়, আমরা আবিষ্কার করেছি বাঙালি নামে যে জাতিটি আছে সেই জাতির ত্যাগ, বীরত্ব ও অর্জন এত সুবিশাল যে তার সঙ্গে তুলনা করার মতো জাতি পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ ৯ মাস আমরা সন্তানহারা মায়ের হাহাকার শুনেছি, স্বামীহারা স্ত্রীর কান্না শুনেছি, ধর্ষিত মেয়ের আর্তনাদ শুনেছি এবং আমি জানি, আমার পক্ষে সেগুলো কোনো দিন ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে আমি যখন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ৯ মাস পর প্রথমবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শুনতে পেরেছিলাম, সেই স্লোগানটিও আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। একটি স্লোগান একটি মানুষের জীবনে কী অবিশ্বাস্য আনন্দ বয়ে নিয়ে আসতে পারে, সেটি সম্ভবত শুধু আমাদের প্রজন্মই অনুভব করতে পারে। আমার মনে আছে, সেই স্লোগানটি শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সুদীর্ঘ ৯ মাসের অমানবিক নিষ্ঠুরতা, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসলীলা, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ও হাহাকার এক মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে একটি অবিশ্বাস্য আনন্দ আমাদের ওপর ভর করেছিল।
আমার মনে আছে, সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার পর ধীরে ধীরে একটি গভীর বিষাদ আমাকে ভর করেছিল। এই ৯ মাস প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় প্রায় বুনো পশুর মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে, কখনো স্বজন হারানোর বেদনাটুকু অনুভব করার সময় পাইনি। যখন জানতে পেরেছি আমাদের আর বুনো পশুর মতো ছুটে বেড়াতে হবে না তখন এই দীর্ঘ ৯ মাসের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ও হাহাকারের স্মৃতি এসে ভর করেছিল। একই সঙ্গে বিজয়ের তীব্র আনন্দ ও স্বজন হারানোর একটি গভীর বিষাদের সেই বিচিত্র অনুভূতিটির কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না।
২.
তারপর কতকাল কেটে গেছে। এখনো ঘুরে ঘুরে বছরের শেষে একটি বিজয় দিবস আসে। এই বিজয় দিবসটি কী এখন শুধু বিজয়ের দিনটি স্মরণ করার দিন? আমার কেন জানি মনে হয়, শুধু স্মরণ করে দিনটি পালন করা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি বিজয় দিবসে আমাদের কোনো একটি নতুন বিজয় অর্জন করার কথা। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মাটি যত মানুষের বুকের রক্তে সিক্ত হয়েছে, পৃথিবীতে সে রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। সেই রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের আরো অসংখ্য বিজয়ের দরকার। ক্ষুধার বিরুদ্ধে বিজয়, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিজয়, অশিক্ষার বিরুদ্ধে বিজয়, কুশিক্ষার বিরুদ্ধে বিজয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজয়, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বিজয়—ইচ্ছা করলেই আমরা দীর্ঘ একটি তালিকা করে ফেলতে পারি। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিজয়টি আমরা কার বিরুদ্ধে অর্জন করতে চাই? সে বিষয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই—আমরা বিজয় চাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি দিয়ে আসলে এর ভয়াবহতাটুকু বোঝানো সম্ভব নয়। এটি বুঝতে হলে এই ভয়ংকর বিষয়ের ভেতর দিয়ে একজনকে যেতে হবে। আমাদের সবার স্মৃতিতে যে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে রেখেছে সেটি হচ্ছে ৩০ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাটি। সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বুঝে গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে একটি আঘাত আসতে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তারা বুঝে গেছে তাদের রক্ষা করার কেউ নেই। নির্বাচনে তারা কাউকে ভোট দেবে এটুকুই শুধু তাদের পরিচয়। এ ছাড়া তাদের অন্য কোনো পরিচয় নেই। তাদের অন্য কোনো প্রয়োজনও নেই। কেউ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। তাই তারা বাড়িঘর ছেড়ে চরে গিয়ে লুকিয়েছিল এবং সত্যি সত্যি তাদের আক্রমণ করার জন্য একজন নয়, দুজন নয়, শত শত মানুষ লাঠিসোঁটা ও অস্ত্র নিয়ে হুংকার করতে করতে ছুটে এসেছিল। তাদের বাড়িঘর লুটপাট করেছে, তাদের মন্দির, উপাসনালয় ধ্বংস করেছে। তখন সম্পূর্ণ নিরীহ মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বুক আগলে নির্জন চরে গিয়ে লুকিয়েছিলেন। যারা যায়নি তারা নির্যাতিত হয়েছে, প্রহূত হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে। এসব মানুষের দোষ কী? তাদের একটি মাত্র দোষ সেটি হচ্ছে, তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাই সব কিছু জানার পরও এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের রক্ষা করার প্রস্তুতি নেয়নি, যখন আক্রান্ত হয়েছে তখন রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেনি। ছোট শিশুরা মানুষের এই বীভৎস রূপ দেখে শিউরে উঠেছে, তাদের কচি মনটি সারা জীবনের জন্য সংকুচিত হয়ে গেছে। তারা কি আর কখনো মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবে?
আমরা যখন সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি বলি তখন সেটি শুধু একটি শব্দ। যখন সাম্প্রদায়িকতা নামের একটি পৈশাচিক প্রক্রিয়া একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে সহ্য করতে হয়, সেটি তখন শুধু একটি শব্দ থাকে না, তখন সেটি তার জীবনের সব স্বপ্নকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়। আমরা সেটি ধ্বংস হতে দিই।
৩.
নাসিরনগরের ঘটনার পেছনের ইতিহাস ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করেছে এবং সেটি জানতে পেরে আমরা আতঙ্কে শিউরে উঠতে শুরু করেছি। প্রকৃত কারণটি ধর্মবিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা থেকে ১০০ গুণ বেশি ভয়ংকর। স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই অংশের ভেতর এক ধরনের রেশারেশি রয়েছে এবং এক অংশকে অপদস্থ করার জন্য অন্য অংশ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ঘটনাটি ঘটানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য একজন অতি নিরীহ নিরক্ষর জেলেকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে একজন নিরীহ নিরক্ষর জেলেরও স্মার্টফোন থাকে এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকে। কিন্তু সেই কম বয়সী জেলের নিজের অ্যাকাউন্টকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা থাকে না। সেই সুযোগটি নিয়ে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ইসলামবিরোধী পোস্ট দিয়ে শত শত হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে আক্রমণ করা হলো। পুরো বিষয়টিই যে বানানো সেটি বোঝার জন্য কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না; কিন্তু আমরা সবিস্ময়ে দেখেছি, কেউ সেটি বুঝতে রাজি হয়নি। একেবারে সবাইকে জানিয়ে-শুনিয়ে হইচই করে, মাইকে ঘোষণা দিয়ে দূর থেকে ট্রাক বোঝাই করে এসে শত শত হিন্দু পরিবারকে আক্রমণ করা হলো। যারা আক্রমণ করেছে তার মধ্যে ধর্মান্ধ মানুষ রয়েছে, সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে এবং নিশ্চিতভাবে স্থানীয় অপরাধীরা রয়েছে; কিন্তু পুরো ঘটনাটি যারা নিখুঁত একটি পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছে তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী! এ দেশকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা যে রাজনৈতিক দলটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, সেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যদি শুধু তাদের প্রতিপক্ষকে অপদস্থ করার জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে আক্রমণ করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, মন্দির ধ্বংস করে একটা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে, তাহলে আমরা কোথায় যাব? এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কি মানুষ নয়? শুধু রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য নাম-পরিচয়হীন কিছু সংখ্যা?
শুধু কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে? আমরা সবাই জানি, সেখানেই শেষ হয়নি, গাইবান্ধায়ও সাঁওতালদের ওপর আরো ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছে এবং সেই আক্রমণে শুধু যে সাঁওতালরা মারা গেছে তা নয়, তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের সর্বস্ব লুট করে নেওয়া হয়েছে। এই অসহায় মানুষগুলোরও বিচারের জন্য কারো কাছে যাওয়ার জায়গা নেই। ১৯৭১ সালের সেই অবিশ্বাস্য বিজয়ের দিনটিতে আমরা সবাই কিন্তু কল্পনা করেছিলাম, আমাদের দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ও বঞ্চনার দিন শেষ হয়েছে। অনেক কষ্ট করে পাওয়া এ দেশে সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব ভাষার মানুষ পাশাপাশি একে অন্যের হাত ধরে বেঁচে থাকব। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর পরও যদি দেখি সেটি ঘটেনি, এ দেশে এখনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা আদিবাসী মানুষরা অবহেলার মধ্যে বেঁচে আছে, তাহলে হঠাৎ করে বিজয় দিবসের আনন্দটুকু ফিকে হয়ে যায়।
আমরা বিজয় দিবসের উৎসবটি উপভোগ করতে চাই। কিন্তু যদি আমরা জানি, এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা আদিবাসী মানুষরা বুকের ভেতর একটা চাপা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটায়, যদি তারা মনে করে এ দেশ আসলে তাদের জন্য নয়—এ দেশে থাকতে হলে তাদের অবহেলা সহ্য করে তুচ্ছ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে, তাহলে হঠাৎ করে আমরা কি নিজেদের প্রতারিত মনে করি না? আমাদের আপনজনরা তো এ রকম একটি দেশের জন্য রক্ত দিয়ে দেশের মাটিকে সিক্ত করেননি।
আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার জীবনে আমি মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে পাশবিক দিকটি যেমন দেখেছি, ঠিক সে রকম সবচেয়ে মানবিক দিকটিও দেখেছি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, মানুষের এই মানবিক দিকই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। কাজেই আমি বিশ্বাস করি, এ দেশেও শেষ পর্যন্ত আমাদের মানবিক শক্তিটিই জয়ী হবে। সেটি করার জন্য আমাদের শুধু নিজের কাছে অঙ্গীকার করতে হবে।
এই বিজয় দিবসে আমরা নিজেদের কাছে অঙ্গীকার করতে চাই, যেভাবেই হোক সবার আগে আমরা এ দেশের মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করবই করব। এ দেশের জেলেপল্লীতে যেন একটি শিশু তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে রাতের বেলা পরম শান্তিতে ঘুমাতে পারে। একটি সাঁওতাল শিশু যেন তার বই-খাতা বুকে চেপে ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে পারে। তারা যেন এ দেশের আকাশ-বাতাস ও মাঠ-ঘাট দেখে মনে করতে পারে, এটি আমার দেশ। তারা যেন এ দেশ নিয়ে ঠিক আমার মতোই স্বপ্ন দেখতে পারে।
লেখক : জনপ্রিয় লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট।