বিনা মূল্যের পাঠ্য বই ৬ মাসও টেকে না - Dainikshiksha

বিনা মূল্যের পাঠ্য বই ৬ মাসও টেকে না

শরীফুল আলম সুমন |

গত শনিবার নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে গিয়ে সপ্তম শ্রেণির এক সেট বিনা মূল্যের বই খুঁজছিলেন আতাউর রহমান। বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে তিনি বই পেলেন। সম্পূর্ণভাবে বিক্রয় নিষিদ্ধ এক সেট বই তিনি কিনলেন ৫০০ টাকায়। দোকানি তাঁকে বইগুলো বড় খামের ভেতর ভরে সুন্দর করে প্যাকেট করে দিলেন। কেউ যেন না দেখে—সে ব্যাপারেও সতর্ক করলেন। জানতে চাইলে আতাউর রহমান বললেন, ‘আমার ছেলে গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে পড়ে। প্রতিবছরই আমার ছেলের দুই সেট বই লাগে। তিন মাস পার হয়েছে, এখনই বই নরম হয়ে গেছে। হয়তো আরো তিন মাস টেনেটুনে চালানো যাবে। ’

আক্ষেপ করে এই অভিভাবক আরো বলেন, ‘আমরা যখন পড়েছি তখন দু-তিন বছরের পুরনো বই সংগ্রহ করে পড়েছি। অথচ এখন সব শিক্ষার্থীকেই নতুন বই দেওয়া হচ্ছে। তার পরও বইগুলো এক বছরও যাচ্ছে না। সামান্য টান লাগলেই ছিঁড়ে যায়। কাগজ এত পাতলা একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকে। ছেঁড়া বই নিয়ে ছেলেটা আবার স্কুলে যেতেও চায় না। তাই আগেভাগেই আরেক সেট বই কিনে রাখলাম। ’

নিম্নমানের বইয়ের এ অভিযোগ শুধু আতাউর রহমানেরই নয়, প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের। প্রতিবছর নতুন বই দেওয়া হলেও সেসব বই কোনোভাবে ছয় মাসের বেশি টিকছে না। যারা কালোবাজারে আরেক সেট বই না কিনছে তাদের সন্তানদের ছেঁড়া বই কোনোমতে পড়তে হচ্ছে। আর এ অভিযোগের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিও। তাদের দাবি, মাধ্যমিকের বইতে ব্যবহৃত অধিকাংশ কাগজই নিম্নমানের। কারণ মাধ্যমিকের জন্য কাগজ কিনে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তারা যে কাগজ দেয় সেই কাগজে মুদ্রণকারীরা বই ছাপতে বাধ্য হয়। কাগজের জিএসএম, ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর, ব্রাইটনেস কিছুই ঠিক নেই। আমাদের দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চাহিদা মোতাবেক কাগজ উত্পাদন বা সরবরাহ করা সম্ভব। অথচ তাদের এই কাগজ সরবরাহের অর্ডার না দিয়ে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাগজ কেনা হচ্ছে বলেই এমনটা হচ্ছে, এ অভিযোগ মুদ্রণ সমিতির।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান  বলেন, ‘বই ছাপার ক্ষেত্রে মানসম্মত কাগজের খুবই দরকার। এখন যদি এনসিটিবি সঠিক মানের কাগজ কিনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা কিভাবে ভালো বই দেব? আর মাধ্যমিকের বইয়ের জন্য কাগজ কিনে দেয় এনসিটিবি। প্রাথমিকসহ বাকি অন্যান্য বইয়ের কাগজ কেনে মুদ্রণকারীরাই। এখন এনসিটিবির কেনা কাগজ যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে অন্যরাও একই মানের কাগজ কিনবে। তাতে এনসিটিবিও বাধা দিতে পারছে না। আমরা অবশ্যই চাই যেসব পেপার মিলের বিএসটিআইয়ের সনদ আছে, তাদের কাছ থেকে মানসম্মত কাগজ কেনা হোক। ’

এনসিটিবি সূত্র জানায়, যেসব পেপার মিল মানসম্মত কাগজ উত্পাদন করে, প্রতিবছর তাদের খুবই কম কাগজ সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর যাদের নিম্নমানের কাগজ সরবরাহের জন্য জরিমানা করা হয়, তাদেরই আবার আগের বছরের চেয়ে বেশি কাগজ সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। অথচ বিএসটিআই সনদ থাকা মিলগুলোর কাছ থেকে মানসম্মত কাগজ কেনা হয় না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা  বলেন, ‘বই তো ছয় মাসে ছিঁড়ে যাওয়ার কথা নয়। আমরা দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কাগজ বুঝে নিই। আমাদের নির্ধারিত এজেন্সি ও অভ্যন্তরীণ কমিটি কাগজের মান নিয়ন্ত্রণ করে। এখন যথাযথভাবে টেন্ডারে অংশ নিয়ে কেউ যদি কাজ পায়, তাহলে তো এনসিটিবির করার কিছু নেই। ’

২০১৪ সালে এনসিটিবির গুদামে সরবরাহ করা কাগজ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণাগারে পাঠায় মুদ্রণ শিল্প সমিতি। সেখানে দেখা যায়, এনসিটিবি দরপত্রে যে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করেছিল, সরবরাহ করা কাগজের মান তার চেয়ে নিম্নমানের। কাগজের ‘ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর’ কমপক্ষে ১২ থাকার কথা থাকলেও পরীক্ষায় পাওয়া গেছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৮, ‘ব্রাইটনেস’ কমপক্ষে ৮০ থাকার কথা অথচ আছে ৬৭ দশমিক ৭৮ এবং ‘জিএসএম’ ৬০-এর বেশি থাকার কথা থাকলেও আছে ৫৮ দশমিক ৮৯। আর কাগজ কতটা মজবুত, কত দিন টিকতে পারে সে জন্য কাগজের ‘ফেয়ার ফ্যাক্টর’ কত, তা জানা জরুরি। অথচ স্পেসিফিকেশনে এ ধরনের কোনো চাহিদাই নেই। এর পরের বছরগুলোতেও প্রায় একই ধরনের স্পেসিফিকেশন চাওয়া হলেও সরবরাহ করা কাগজ তার চেয়েও অনেক নিম্নমানের। এমনকি কাগজ কেনার জন্য দরপত্রের শর্তে মিলগুলোর বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকার কথা উল্লেখও করা হয় না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কিছু ট্রেডার্স আছে, যারা বিভিন্ন কাগজকলের অথরাইজড, তাদেরও কাগজ সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। গত বছর দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি পেপার মিলের ব্যাপারে মাত্র পাঁচ-ছয় বছর ধরে কাগজ উত্পাদন করার অভিযোগ পাওয়া গেলেও তাদের কাছ থেকেও কাগজ কেনা হয়েছে। একটি পেপার মিলে দরপত্র মূল্যায়নের টেকনিক্যাল কমিটি গিয়ে দেখতে পায়, তাদের গ্যাসের লাইন কাটা। পাঁচ-ছয় বছর ধরে তারা কাগজ উত্পাদন করছে না। আরো দুটি মিলে দেখা যায়, মানহীন কাগজ উত্পাদন করেও তারা বিএসটিআইয়ের সনদ জাল করে ব্যবহার করছে। এসব প্রতিষ্ঠানকেই কাগজ সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়।

প্রতিবছর দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে ৩৬ কোটি বই বছরের প্রথম দিনে তুলে দেওয়া সরকারের অন্যতম বড় অর্জন। এটা সারা বিশ্বেও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে সরকারের এই অন্যতম সাফল্যকে ম্লান করতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। তারাই নিম্নমানের কাগজ কিনে যাচ্ছেতাই বই তুলে দিচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044858455657959