‘বিশেষ কর্মকর্তা’ পদে ছাত্রলীগের ১২ জন - দৈনিকশিক্ষা

‘বিশেষ কর্মকর্তা’ পদে ছাত্রলীগের ১২ জন

মুসা আহমেদ |

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য মীজানুর রহমান। তাঁদের মধ্যে দুজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, অন্যরা এই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মী।

গত ১৯ মার্চ উপাচার্যের আগের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে অস্থায়ীভাবে ও চুক্তিভিত্তিক এই ১২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ওপর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। ২০ মার্চ মীজানুর রহমান দ্বিতীয় মেয়াদে আরও চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পান। এর আগে ২০১২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের ৩১ জন নেতা-কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদের সময়ে ২০১২ সালে।

জানতে চাইলে উপাচার্য মীজানুর রহমান  বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরি দিতে আমি বাধ্য। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ১২ জন কঠোর পরিশ্রমী নেতা-কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে দুজন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা। এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ তাহলে সাধারণ প্রার্থীদের কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা।’

মীজানুর রহমান একসময় আওয়ামী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। প্রথম মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার পর এই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে গত বছরের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি কাউন্সিলর ছিলেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।

বিশেষ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য আনোয়ার হোসাইন ও মিজানুর রহমান; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি দানেশ মিয়া, আরেফিন কাওসার, প্রশান্ত মৃধা, আবদুল্লাহ আল মামুন, এ কে এম কামরুজ্জামান, জিয়াউর রহমান ও আবদুস সালাম; আপ্যায়ন সম্পাদক নুরুল হুদা, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক আশিকুজ্জামান, কর্মী বিশ্বজিৎ মল্লিক। তাঁরা রেজিস্ট্রার দপ্তরের অধীনে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের নিয়োগপত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপত্র কথাটি উল্লেখ রয়েছে। তবে কত দিনের জন্য নিয়োগ তা বলা হয়নি।

এই কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্প্রতি পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা  বলেন, ২০১৫ সালে তাঁদের সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু নানান জটিলতায় নিয়োগ আটকে যায়। এর মধ্যে উপাচার্যের মেয়াদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ শেষ পর্যায়ে চলে আসায় তড়িঘড়ি করে ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের বিশেষ কর্মকর্তা পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিগগিরই স্থায়ী করার আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য। ৩০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিন্ডিকেট সদস্য ও দুজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে ছয়জনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০তম সিন্ডিকেট সভায় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সভা চলাকালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঢুকে পড়ে ৬ পদের বিপরীতে ১২ জনকে নিয়োগ দিতে উপাচার্য ও সিন্ডিকেট সদস্যদের চাপ দেন। সিন্ডিকেট সদস্যরা এর বিরোধিতা করলে নিয়োগ হয়নি। ২০ ডিসেম্বর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইউজিসি, যা এখনো বহাল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের তিনজন কর্মকর্তা বলেন, ইউজিসির নিষেধাজ্ঞার পর চাকরিপ্রার্থীরা টাকা ফেরত অথবা স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করতে শরিফুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলামকে চাপ দেন। তাঁরা দুজন চাপ দেন উপাচার্যকে। চাকরি না দিলে তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য পদে নিয়োগে বাধা দেওয়ার এবং আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। পরে ১০ ফেব্রুয়ারি ওই ১২ জনকে বিশেষ কর্মকর্তা পদে আবেদন করতে বলেন উপাচার্য। তাঁরা আবেদন করেন। তবে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি, ইউজিসির অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। আবেদনকারীদের কম্পিউটারে বাংলা ও ইংরেজি লেখার পরীক্ষা নেওয়া হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁদের অধিকাংশই অকৃতকার্য হন। তারপরও ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।

তবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শরিফুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম। তাঁরা বলেন, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, এটা সত্য। কিন্তু তাঁরা নিজ যোগ্যতা দিয়েই চাকরি পেয়েছেন। টাকা লেনদেনের বিষয়টি ভিত্তিহীন। এর কোনো প্রমাণও নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ওহিদুজ্জামান স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্রে দেখা যায়, বিশেষ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যোগদানের তিন মাসের মধ্যে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটারে সার্টিফিকেট কোর্স (বাংলা ও ইংরেজি লেখার দক্ষতা অর্জন) করতে হবে। সময়মতো এই কোর্স সম্পন্ন করলে বেতন বাড়বে।

জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার বলেন, কম্পিউটারে বাংলা ও ইংরেজি লেখার দক্ষতার ওপর নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেতন ধরা হয়েছে। দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই কম্পিউটারে লেখার পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছেন। ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কাউকে বেতন মাসে ৫ হাজার, কাউকে ১০ হাজার, কাউকে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। ওই শর্ত পূরণ করলে প্রত্যেকে মাসে ২০ হাজার টাকা করে বেতন পাবেন।

কেবলই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীদের নিয়োগ

২০১২ থেকে ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তিনবার। এর মধ্যে গ্রেড-১-এর জন্য একবার ও গ্রেড-২-এর জন্য দুবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১২ সালে সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে নয়জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক ২২ নেতা-কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ। গ্রেড-২-এ দুই বছর চাকরি করার পর গ্রেড-১-এ পদোন্নতির নিয়ম থাকলেও তাঁরা এক বছরের মাথায় মেসবাহউদ্দিনের সময়েই গ্রেড-১-এ পদোন্নতি পান।

২০১৩ সালের মার্চে উপাচার্য নিযুক্ত হন মীজানুর রহমান। এর ছয় মাসের মাথায় সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে চারজন ও স্টোর অফিসার পদে একজনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আবেদন করেছিলেন ছাত্রলীগের ৫০ নেতা-কর্মীসহ ৪৭০ জন। কিন্তু ছাত্রলীগের নয়জনসহ ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য দুজন ছিলেন উপাচার্যের ‘পছন্দের কোটার’। এর এক বছরের মাথায় সেকশন অফিসার গ্রেড-১-এর ছয়টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই ১১ জনকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। সবশেষে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশেষ কর্মকর্তা পদ তৈরি করে নিয়োগ দেওয়া হলো ছাত্রলীগের ১২ নেতা-কর্মীকে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসারের (গ্রেড-১) মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীই দুই-তৃতীয়াংশ।

সৌজন্যে: প্রথম অালো

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.01003098487854