বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমন্বিত ব্যবস্থা চাই - Dainikshiksha

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমন্বিত ব্যবস্থা চাই

মোহাম্মদ কায়কোবাদ |

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের হার কমেছে, কমেছে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা, বেড়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। আমরা এত দিন পাসের হারের সঙ্গে শিক্ষার মানের পজিটিভ কোরিলেশনে আস্থা রাখার ফলেই এই উদ্বেগ। মানকে উন্নত করতে হলে মানদণ্ড এমন হওয়া উচিত, যাতে তার শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সব বোর্ড মিলে ৩৭ হাজার ছাত্রছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। শুধু তাদেরই নয়, তাদের অভিভাবকদেরও প্রত্যাশা, তারা পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমাফিক বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে। নানা কারণে প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ের পছন্দে আমাদের ছাত্র কিংবা তাদের অভিভাবকেরা তত উদার নন—চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে হবে, নয়তো প্রকৌশলী অথবা ব্যবসায় প্রশাসন। উন্নত বিশ্বে ছাত্রদের পছন্দের তালিকা বেশ বড়। কেউ পড়তে চায় সংগীত, কেউবা নাচ অথবা ইতিহাস কিংবা চারুকলা, পদার্থবিজ্ঞান। তাই লাখ লাখ ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা পরীক্ষার ফলাফলে যতটা ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় দেড় শ। ইচ্ছা থাকলেও একজন ছাত্র সব জায়গায় কেন, এর এক-দশমাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরীক্ষা দিতে যেতে কী পরিমাণ ভোগান্তিতে যে ছাত্র ও অভিভাবকেরা পড়বেন, তার জন্য আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো প্রস্তুতি, সহানুভূতি আছে কি না। আমাদের ছাত্ররা নানা ধরনের অলিম্পিয়াডে ভালো করে বিনা ভর্তি পরীক্ষায় এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলে, হার্ভার্ড ইত্যাদি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। দেশের পতাকা যারা বিশ্বসভায় ওড়াচ্ছে, বিদেশে তাদের সম্মান-দাম থাকলেও নিজের দেশে নেই। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন, তারা আমাদের এই খুদে বিজ্ঞানীদের বিনা ভর্তি পরীক্ষায় ভর্তির সুযোগ করে দিয়ে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা বর্ণের, নানা গোত্রের, নানা দেশের, নানা ভাষার ছাত্রদের ভর্তি করতে ভর্তি পরীক্ষাই নিচ্ছে না, সেখানে আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তাদের চরম বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছি, যদিও আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনো র‍্যাঙ্কিংয়েই সম্মানজনক স্থান পাচ্ছে না। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জাফর ইকবাল কয়েক বছর আগে টেস্ট কেস হিসেবে যশোর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একসঙ্গে করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ করার জন্য সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী বদ্ধপরিকর ছিল।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই চায় যোগ্য ছাত্রছাত্রী যাতে ভর্তির সুযোগ পায়। তাই বলে আমরা কি সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি? বিভিন্ন বোর্ডের নম্বর কিংবা গ্রেডের মান কি একই? একজন ছাত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যানজটে নাকাল হয়ে শাহজালাল কিংবা চট্টগ্রামে যদি ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায়, তাহলে কি সে সমান সুবিধা পাচ্ছে? সুতরাং অনেক কিছুই আমাদের নাগালের বাইরে। একজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করায় কিন্তু তার কপাল খুলবে এমন নয়। এমনও হতে পারে যে এখানেও সে ভর্তি হতে পারল না আবার অন্য জায়গার জন্যও ভালো প্রস্তুতি নিতে পারল না। সুতরাং এখানে চলকের সংখ্যা অনেক—সমতা বিধানের চেষ্টায় আমরা যথেষ্ট অসহায়। নানা জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিড়ম্বনা থেকে আমাদের পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের পরিত্রাণের জন্য আমাদের সরকারের, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নিশ্চয়ই কিছু করণীয় রয়েছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বেশ কয়েক বছর লেখালেখি হলেও কোনো রকম ইতিবাচক কর্মসূচি এখনো নজরে পড়ছে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরস্পরের প্রতি আস্থার অভাব। বোর্ডের ফলাফল গ্রহণযোগ্য না হলেও তার ওপর ভর করেই আমরা পরীক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছি। বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফল সমমানের বলে মেনেও নিচ্ছি। অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদে আমরা নানা ধরনের ছাড় দিচ্ছি। এবার আমাদের আরেক ধাপ এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ছাত্রদের বারবার ভর্তি পরীক্ষা থেকে নিস্তার দিতে হবে, এর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এর আগে অনেকবার গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির নানা প্রস্তাব এসেছে। আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো (বেসরকারিগুলোসহ) একটি পরীক্ষার মাধ্যমেই সব মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করছে। এখন এই পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বেশি। অতীব পুরোনো এবং সম্ভবত অধিকতর খান্দানি ঢাকা মেডিকেল কলেজ তুলনামূলকভাবে নবীন পাবনা কিংবা খুলনা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও তুলছে না। তাহলে অন্যান্য বিষয়ে আমরা একই কাজ কেন করতে পারব না? পরস্পরকে আমরা আস্থায় না আনলে আমাদের মধ্যে আস্থা বাড়বে না। প্রয়োজনে এ রকম সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার শুরুতে ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই ভর্তি পরীক্ষার লঙ্কাকাণ্ড শুরু হবে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য আবারও প্রস্তাবটি তুলে ধরছি—

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের (শুরুতে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও করতে পারে) উপাচার্য মহোদয়েরা একসঙ্গে এই মতৈক্যে পৌঁছান যে জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য হলেও সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়া আবশ্যক। এর জন্য সাধারণ গাইডলাইনও তাঁরা তৈরি করবেন। যেমন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মূল্যায়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ভর্তিকেন্দ্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি প্রেরণ, বিষয়ের কতগুলো গুচ্ছ হতে পারে যেমন মানবিক, ব্যবসায়, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, জীববিজ্ঞান। সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র ফাঁস এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বশেষ সময়ে তা প্রণয়ন (যেমন পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে নানা কেন্দ্রে প্রেরণ করা হলে প্রশ্নফাঁসজনিত অসমতা হ্রাস পাবে)। এমসিকিউ পদ্ধতিকে কার্যকর করার জন্য প্রশ্ন ও উত্তরের নানা পারমুটেশন কম্বিনেশন করে অসদুপায় অবলম্বনকারী ছাত্রদের নকল করার কাজটি কঠিন করে তোলা সম্ভব।

এ রকম একটি পরীক্ষাপদ্ধতির সূচনার ফলে ছাত্রদের কিংবা সমাজের কাছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কিংবা গ্রহণযোগ্যতাও কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি উৎকর্ষ অর্জনের সুস্থ প্রতিযোগিতা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজার হাজার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পাচ্ছে না, যদিও আমরা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশ। প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং প্রথা চালু আছে, যার মাধ্যমে তারা উৎকর্ষ অর্জনের নিরন্তর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ভারতে আছে, পাকিস্তানে আছে, আছে মালয়েশিয়ায়। তারা এই তালিকায় তাদের অবস্থান শক্তিশালীও করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন র‍্যাঙ্কিং নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুধু আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের নেতাই নন, তাঁরা আমাদের জাতির বিবেক। তাঁদের এই বিবেক ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করে যানজটে বিধ্বস্ত মহানগরগুলোতে অবস্থিত সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের ভর্তির বিড়ম্বনা হ্রাস করে সবাইকে কৃতার্থ করতে পারেন। এ শুধু ভর্তির বিড়ম্বনা নয়, ছয় লাখ ছাত্রছাত্রী যদি ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেকে যদি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাহলে যাতায়াত, ছাত্রীদের জন্য অভিভাবকদের সময় এবং প্রতিটি পরীক্ষায় যদি গড়ে হাজার টাকা খরচ হয় (ঢাকার বাইরে থেকে আসা পরীক্ষার্থীদের হোটেলে থাকা) তাহলে সহজেই তিন-চার শ কোটি টাকা এ বাবদ ব্যয় হবে। এরপর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুর্ভোগ, দুর্ঘটনা এগুলোও তো সঙ্গে আছে।

আমরা যদি বোর্ডের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের একটি সমাধান আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তিতে স্যাটের ফলাফল ব্যবহার করে। এ রকম একটি ব্যবস্থা চালুর কথাও আমরা চিন্তা করতে পারি। এর মাধ্যমেও কিন্তু বিভিন্ন স্কুল-কলেজের পড়ালেখার মানের মধ্যে তুলনা করা যেতে পারে। এ নিয়েও আমাদের শিক্ষা নীতিনির্ধারকদের চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত এবং তা অবিলম্বেই। তবে যত দিন এ কাজগুলো করা যাচ্ছে না, তত দিন মনে হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প নেই। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ লাঘবে এটা করতে হবে।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.021793127059937