অধিকার, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে আমরা কম-বেশ সকলে পরিচিত । মানব সভ্যতা প্রসারিত হবার সাথে সাথে সারা পৃথিবী জুড়ে এ জাতীয় শব্দের আবেদন অনেক বেড়ে যায়। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা কাজ করে। কোথায় মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত , কোথায় মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত-সে সব তারা দেখভাল করে। প্রয়োজনে সোচ্চার হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি এ জাতীয় নানা সংস্থা আমাদের দেশে ও কাজ করে।
এখন মে মাস। গতদিন সারা বিশ্বে প্রতি বছরের ন্যায় পালিত হলো ‘মে দিবস’ তথা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’। এ দিবসের কারণে মে মাসের আলাদা মাহাত্ম্য ।
এবার মে দিবস নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালে ক’জন শ্রমিকের আত্মদান আজকের মে দিবস ও পুরো মে মাসকে মহিমান্বিত করেছে। এ দিন শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি ও দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। দিনটিতে দাবী আদায়ের জন্য তারা ধর্মঘট আহ্বান ও শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে প্রায় তিন লাখ মেহনতি মানুষ অংশ নেয়। শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে ১১ জন শ্রমিক সেদিন প্রাণ হারায়। আহত ও গ্রেপ্তার হয় অনেকে। প্রহসনমুলক বিচারে গ্রেফতারকৃত ছয়জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কারাগারে বন্দি দশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহনন করেন। এ সবের জের ধরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে পহেলা মে তারিখকে শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে পালিত হয় ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।
বোশেখ মাসের শেষ পক্ষ এখন। মে মাসের শুরু। এমপিও শিক্ষকের বোশেখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট না পাবার কষ্ট মে মাসের প্রেক্ষাপটকে সঙ্গত কারণে সামনে টেনে নিয়ে আসে।
মে দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার পর শ্রমিকদের দৈনিক কর্মঘন্টা ১৬ থেকে ৮ ঘন্টায় নেমে আসে। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা এগিয়ে যায়। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের নতুন এক অধ্যায়। মে দিবস বৈষম্যের বেড়াজাল ছিন্ন করার শপথ নেবার দিন। শ্রেণি বৈষম্য দুর করার দৃপ্ত অঙ্গীকারের দিন। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ গোটা বিশ্বকে উপহার দেয় এই মে মাস।
এবার সর্ব সাম্প্রতিক এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের দু’টো বঞ্চনা অর্থাৎ বোশেখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট প্রসঙ্গে আরেকটু আলোকপাত করা যাক। জানিনে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জেনেছেন কীনা? তবে ইতিমধ্যে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত এটি জেনে গেছেন। আশার আলো জ্বলে ওঠে আবার দপ্ করে নিভে যায়।
সৃজনশীল-অসাম্প্রদায়িক বোশেখি ভাতা এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্টটি শিক্ষকদের তো বটে, অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলভুক্ত যে কোন পেশাজীবি মানুষের দু’টো মৌলিক অধিকার। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীর একান্ত ন্যায্য পাওনা ও মৌলিক চাহিদা বটে। দেশের বেসরকারি বলে কথিত শিক্ষকগণ ভিন দেশের যেমন নাগরিক নন, তেমনি তারা কোন পরাধীন দেশের বাসিন্দা ও নন। তারা সরকারি নির্দেশনার আলোকে স্বীয় কর্মে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সরকার অনুমোদিত ছুটি ভোগ করেন । সরকারি বিধি বিধান মেনে চাকরী পরিচালনা করেন। সরকারি বিধিমতে অবসর গ্রহণ করেন। সরকার আরোপিত সকল বাড়তি দায়িত্ব নির্দ্ধিধায় পালন করেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শতভাগ মুল বেতন পান। একটা সময় পাকিস্তান আমলে এ দেশের শিক্ষকগণ কিছুই পাননি। পরাধীনতার যন্ত্রণা ও গ্লানি বড় ছিল বলে এ সবে তাতে কষ্ট লাগেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষকরা বোশেখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট পাবেন না-সে তো মেনে নেয়া যায় না। স্বাধীন দেশে শিক্ষকদের প্রতি এ কেমন পরাধীন আচরণ?
একজনের অধিকার অন্যজনের কর্তব্য। অধিকার ও কর্তব্য তাই অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত দু’টি বিষয়। কেউ নিজের কর্তব্য কাজটি যথাযথ সম্পাদন না করলে যার অধিকার সে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত মানুষের মনের কষ্ট বুঝিয়ে বলার নয়। অধিকার বঞ্চিত একজন মানুষের মনের কষ্ট সাধারণ মানুষের হাজার কষ্টকে ছাড়িয়ে যায়।
প্রত্যেক মানুষের কতকগুলো মৌলিক অধিকার আছে। অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান, শিক্ষা , চিকিৎসা-এ গুলো প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। এ গুলো ছাড়া মানুষের জীবন অচল ও অসার। এ সবের যে কোন একটি বাদ দিয়ে মানবজীবনে পুর্ণতা আসে না। তাই, যুগে যুগে মানুষ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেন দরবার ও আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। মে দিবস তারই এক গৌরবোজ্জল স্মারক দিন।
অনরুপ, যে কোন পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবি মানুষের পেশাগত কিছু মৌলিক অধিকার থাকে। সে সব অধিকার তার পেশাগত উৎকর্ষতা যেমন বৃদ্ধি করে, তেমনি সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে শেখায়। এ সব থেকে কাউকে বঞ্চিত করা মর্যাদার অবমাননা ছাড়া কিছু নয়।
মে আর বোশেখ একাকার হয়ে বোশেখি ভাতার কষ্টটি দ্বিগুন করে তুলেছে। মে দিবস থেকে দেশের শিক্ষক সমাজ শিক্ষা না নিলে কপালে আরো দুর্গতি অপেক্ষা করছে।
বোশেখি ভাতা ও ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট-দু’টোই অষ্টম জাতীয় বেতনস্কেলের অসারণ বৈশিষ্ট্য। প্রথমটি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত ও সুদৃঢ় করে এবং দ্বিতীয়টি কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে।
সে সুযোগ ও মর্যাদা থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্দয় ভাবে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।
অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যত মহৎ ও গৌরবোজ্জল আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে, সে সব মানুষের অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার জন্য। মে দিবস ও নিরন্তর সে শিক্ষাই প্রতি বছর দিতে আসে। জয়তু মে দিবস। জয় হউক দুনিয়ার মেহনতি মানুষের। শিক্ষকদের মেহনত বৃথা যেতে পারে না। তাদের শ্রমেই জাতি পরিপুষ্ট ও আত্মমর্যাদাশীল হয়ে ওঠে।