ব্যবসায়ীরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন কী? - দৈনিকশিক্ষা

ব্যবসায়ীরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন কী?

ড. আর এম দেবনাথ |

অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বলতেই হবে দেশের অর্থনৈতিক খবরের মধ্যে ব্যাংকের খবরই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। প্রতিদিন কোন না কোন কাগজে ব্যাংকের ওপর খবর থাকেই। কখনও কখনও একই ব্যাংকিং খবর সব কাগজে ফলাও করেও ছাপা হয়। বলা বাহুল্য, এসব খবরের বেশিরভাগই নেতিবাচক খবর। ব্যাংকের ওপর ভাল খবর থাকে কদাচিৎ। ইদানীং দেখছি বীমা খাতও আলোচনায় আসছে। যেমন গত মঙ্গলবারের কাগজে ব্যাংকের ওপর যেমন নেতিবাচক খবর আছে, তেমনি নেতিবাচক খবর আছে বীমা খাতের ওপরও। প্রথমেই বীমা খাতের খবরের কথাই বলি, যা উল্লেখ করেছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বীমা সম্পর্কিত এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বীমা খাতকে জীবনদান করতে হবে। বলা বাহুল্য, খুবই খাঁটি কথা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বীমা খাত আমাদের দেশে অত্যন্ত অবহেলিত। এটা আমাদেরই দোষ। এই খাত নিয়ে আগে নজর দেয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, বীমা খাত আরও এগোনো উচিত ছিল। বীমা কোম্পানির সংখ্যা ভাল। কিন্তু ব্যবসা তত বিস্তৃত হয়নি। অর্থমন্ত্রী আরও মনে করেন অবহেলার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঝুঁকি বাড়ছে। এই খাতে প্রশিক্ষিত লোক নেই। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। আমি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের কোন সুযোগ পাচ্ছি না। কিন্তু এর পরেও কথা থেকে যায়। এই খাতটি বেশ বড় খাত। ডজন ডজন কোম্পানি সাধারণ ও জীবন বীমা ব্যবসা করছে ১৯৮২-৮৩ সাল থেকে। হিসাবে প্রায় ৩৪ বছর। ৩৪ বছর পর বলা হচ্ছে, এই খাতটি অবহেলিত। কিন্তু অবহেলিত হওয়ার মানে তো এ কথা নয় যে, তারা গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করবে না! অবহেলিত হওয়া মানে তো এই নয় যে, মালিকদের অনেকেই বীমা প্রিমিয়ামে তাদের ব্যবসা ‘বীমা’ করবে! অবহেলিত হওয়া মানে তো এই নয় যে, বীমা কোম্পানিগুলো গ্রামের লোকদের দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাবে! অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব হয়ে আসছে, আজও হচ্ছে। অনেকেই ‘পুনর্বীমা’ (রি-ইনসিওরেন্স) পর্যন্ত করে না।

এসব অনিয়মের মধ্যেই এই খাত বড় হয়েছে এবং হচ্ছে। মাঝখানে একটা নিয়ন্ত্রণী সংস্থা করা হয় যার নাম ‘ইনসিওরেন্স ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড রেগুলেটরি’ সংস্থা (ইডরা)। দেখা গেল সংস্থাটির অবদান খুবই কম। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ব্যক্তিদের অনিয়মই প্রচুর। কাগজে এসব ছাপা হয়েছে। তবে আশার কথা ৩৪ বছর সরকারের বোধোদয় হয়েছে, এই খাতটি অবহেলিত। তাহলে এখন দরকার যথাযথ পদক্ষেপ। এই কাজটি যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। সর্বাগ্রে দরকার বীমা গ্রাহকদের দাবি (ক্লেইম) খাতে যাতে নিয়মিত এবং সময়মতো পরিশোধ করা হয় তার একটা পাক্কা ব্যবস্থা করা। এই ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যর্থতা পাহাড়সম। কোম্পানির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে বীমা গ্রাহকরা তাদের ‘ক্লেইমের’ কথা শেষ পর্যন্ত ভুলেই যান। দ্বিতীয়ত দরকার ‘কমিশন’-এর নামে যে লুট হয় তা বন্ধ করা। এই দুটো কাজ করতে পারলে বীমা কোম্পানির ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে বলে মনে হয়। আমাদের নতুন প্রজন্মের বীমা ও ব্যাংক ব্যবসায়ীদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা আমেরিকায় বসবাস করেন এবং চান আমেরিকার মতো ব্যবসা। কিন্তু তাদের কার্যপদ্ধতি সেকেলে। এই দ্বিচারিতা বন্ধ হওয়া দরকার।

দ্বিচারিতা বন্ধ হওয়া দরকার ব্যাংকিং খাতেও। এই খাতে যে কী হচ্ছে তা স্বয়ং ঈশ্বরও বলতে পারবেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুহূর্তে বিব্রত নতুন ছয়টি বেসামরিক ব্যাংক নিয়ে। দেশে ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে এই ছয়টি ব্যাংক বেসরকারী খাতে এসেছে সবার পরে। কিন্তু আলোচনায় তারা সবার প্রথমে। তাদের সম্পর্কে এই পর্যন্ত কোন ভাল খবর যতদূর মনে পড়ে, পড়িনি। তারা আইনকানুন মানে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানে না। যেসব শর্তে তাদের ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তা তারা পূরণ করেনি। মালিকদের মধ্যে রয়েছে দলাদলি। ঋণ বিতরণে যথেচ্ছাচার করছে তারা। এমনকি কর্মী, কর্মচারী নিয়োগেও তারা যথেচ্ছাচার করছে বলে অভিযোগ। অথচ এদের মালিকরা সবাই সরকারী দলের বিখ্যাত সব ব্যক্তি। সরকারের, দলের বদনাম করে তারা দিব্যি কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘জেগে’ উঠেছে। একটি ব্যাংকের ওপর তারা বেশকিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা ভাল খবর। কিন্তু যেটা আমি বুঝতে অক্ষম তা হচ্ছে নতুন ব্যাংকের খবরে। আবার নতুন ব্যাংক দেয়ার কথা হচ্ছে এমন সময়ে যখন সরকারী প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের’ আলোচনা সভায় পুরনো ব্যাংকগুলো নিয়েই আক্রমণাত্মক একটি খবর ছাপা হয়েছে।

একটি দৈনিকে দেখলাম সেখানে এক আলোচনা সভায় ব্যাংকাররা বলেছেন, ‘নদী আর ভূমি দখলের মতো ব্যাংকিং খাতেও দখলদারিত্ব চলছে। এর প্রভাব পড়ছে সমাজ ব্যবস্থায়। দিনে দিনে বৈষম্য বাড়ছে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়নের জন্য শক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ঘাটতি রয়েছে।’ বলা বাহুল্য, উত্থাপিত অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। চর দখল হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নদী দখল হচ্ছে তাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভূমির মালিক হওয়া এখন ভীষণ বিড়ম্বনা। কখন কে তা এক থাপ্পড় মেরে নিয়ে যায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের অবস্থাও তাই। এটা দারুণ দুশ্চিন্তার বিষয়। জমি একজন বা দুইজনের যায়; বড়জোর ২০-৫০ জনের। নদী দখল হলে তার ক্ষতি বহন করে সরকার। কারণ নদীর মালিক সরকারÑ যদিও প্রকারান্তরে নদীর মালিক জনগণ। কিন্তু ব্যাংক দখল হলে তো বড় বিপদ? এখানে মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় রক্ষিত থাকে। ব্যাংকের টাকা সরকারের টাকা নয়। ব্যাংক দখলদারদের হাতে গেলে এর পরিণাম মারাত্মক হতে বাধ্য।

অথচ অভিজ্ঞ ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা এই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। যতদূর দেখা যাচ্ছে, এদের অনেকেই সরকার সমর্থক এবং ফলাও করে যারা খবর ছাপছেন, তারা সরকারের মন্ত্রীর লোক। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? এটা তো বিরোধীদলীয়দের কথা নয়। অতএব সরকারের উচিত এসব কথা আমলে নেয়া। উল্টো বরং শুনতে পাচ্ছি আরও দুটো নতুন ব্যাংক নাকি অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। কাগজে দেখলাম অর্থমন্ত্রী নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। দেশে ইতোমধ্যেই কাজ করছে ৫৭টি ব্যাংক। যোগ হবে আরও দুটো ব্যাংক। বলা হচ্ছে পুলিশ, নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানও ব্যাংকের জন্য দরখাস্ত করেছে। সরকারী কর্মচারীদের জন্য ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংকের’ সুপারিশ করেছে ‘পে কমিশন’। খবরে বলা হচ্ছে ৮০টি ব্যাংকের দরখাস্ত নাকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা আছে। খুবই মজাদার খবর। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভাল নয়। প্রতিদিন এ সম্পর্কে খবর ছাপা হচ্ছে। আগে বলা হতো সরকারী ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। এখন বেসরকারী ব্যাংকের অবস্থাও যে খারাপ খবরও ছাপা হচ্ছে।

এমনকি লিজিং কোম্পানি জাতীয় যেসব ‘নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট অব’ (এনবিএফআই) আছে তাদের অবস্থাও নড়বড়ে। এর পরও দেখা যাচ্ছে শেয়ার বাজারে ব্যাংকের শেয়ার নিয়েই নর্তন-কুর্দন। এর অর্থ কী? সাধারণ শেয়ার মালিকরা খারাপ সংবাদ শোনার পরও কেন ব্যাংকের শেয়ার কেনে? তবে কী আসল খবর ভিন্ন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ব্যাংক যদি এত খারাপই হতো তাহলে সবাই ব্যাংকের ব্যবসা করতে চায় কেন? ৮০টি দরখাস্ত নতুন ব্যাংকের জন্য। বর্তমানে আছে ৫৭টি। আরও ৮০টি নতুন ব্যাংকের দরখাস্ত। এর অর্থ কী? একটি ব্যাংক করতে ৪০০ কোটি টাকা পুঁজি লাগে। একদম পারিশোধিত টাকা বা পুঁজি। শুনেছি তাও এই টাকা ‘সাদা টাকা’ হতে হয়। এর অর্থ কী ৮০টি ব্যাংকের দরখাস্তকারীদের কাছে ৩২ হাজার কোটি ‘কর পরিশোধিত’ (ট্যাক্স পেইড) টাকা আছে? খুবই বড় খবর। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তো খুশির খবর। না কি এই টাকা আসবে ‘ব্যাংক ফিন্যান্স’ থেকে? জানি না।

যদি তা না হয়, তাহলে এতো আনন্দের সংবাদ দেশে এত কর পরিশোধিত টাকা আছে! এমতাবস্থায় এসব ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে আমার একটা নিজের ‘দরখাস্ত’ আছে। সবাই জানি এটা নবেম্বর মাস। ডিসেম্বর এসে গেছে। দেশে এবং ঢাকা শহরে ভর্তিযুদ্ধ। ভাল স্কুল নেই, ভাল কলেজ নেই এমনকি ভাল বিশ্ববিদ্যালয় নেই, ইনস্টিটিউট নেই। বিশেষ করে নেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল। ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল তো হাতেগোনা। ওইসব স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মন্ত্রীর সুপারিশ লাগে।

এমতাবস্থায় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে আকুল আবেদনÑ আপনারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংক বানানোর দরখাস্ত তুলে নিয়ে তা প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিন। বলুন, আমরা সারাদেশে শত শত ভাল প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে চাই। আমরা ঢাকাসহ সারাদেশে শত শত ভাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে চাই। আমরা অঙ্ক, ইংরেজী, বিজ্ঞান শিক্ষক গড়ে তুলতে চাই। যদি তা করেন তা হলে আমি নিশ্চিত দেশবাসী আপনাদের দোয়া করবেন এবং আপনাদের নবলব্ধ পুঁজি প্রকৃতপক্ষেই দেশের কাজে লাগবে। আপনারা ব্যাংকের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে দেশবাসী কৃতার্থ হবেন। আপনারা তা করবেন কী? জানার আগ্রহ রইল। আরও জানার আগ্রহ রইল সরকার আপনাদের স্কুল করতে উৎসাহিত করবে কী না। ‘ইকোনমিক জোন’ করুন, শিল্প করুন, ব্যবসা করুন, সঙ্গে সঙ্গে স্কুল করুন, ভাল স্কুল করুন, গাছ লাগান, খাল-বিল পুনর্খনন করুন- তাহলে দেশবাসী দোয়া করবে ব্যবসায়ী ভাইদের।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি

 

সৌজন্যে: জনকণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041370391845703