‘ভর্তি যুদ্ধ’ যেন ‘ভর্তি বাণিজ্য’ না হয় - দৈনিকশিক্ষা

‘ভর্তি যুদ্ধ’ যেন ‘ভর্তি বাণিজ্য’ না হয়

ড. মাহফুজ পারভেজ |

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণে চলছে ভর্তির মওসুম। ক’দিন পরেই দেশব্যাপী শতাধিক প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাগলের মতো ছুটাছুটি শুরু করবে ভর্তিচ্ছুরা। আজকে ঢাকা, কালকে চট্টগ্রাম, পরশু সিলেট, তারপর দিন রাজশাহী ছুটতে হবে তাদের। সকালে এক নগরে পরীক্ষা সেরেই বিকালেই আরেক নগরে ধাওয়া করতে হবে ভর্তি নামক সোনার হরিণের সন্ধানে। এমন পরিস্থিতি ‘ভর্তি যুদ্ধ’ নামে অভিহিত হয়।

ভর্তি, কেবল উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, নিম্নতর স্তরেও রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ ভর্তিচ্ছুর বিপরীতে আসন স্বল্পতার কারণে এমন উৎকট ও অসম প্রতিযোগিতার উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক, যার ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই ভর্তির সুযোগ বঞ্চিত হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীর সামনেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও সম্ভাবনা সঙ্কুচিত হয়ে আসে। অনেক মেধাবীই তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ঝরে যাবে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছরই স্বল্প আসনের বিপরীতে কমপক্ষে দুই লক্ষাধিক ভর্তিচ্ছু অংশ নেয়। এবারও এর ব্যতয় হবে না। ভর্তিচ্ছুদের সঙ্গে থাকেন আরো কয়েক লাখ উদ্বিগ্ন অভিভাবক। পরীক্ষার বাইরেও অনেকে নানা পন্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। ফলে প্রকৃত মেধাবীদের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে চাপ ও প্রভাবমুক্ত, অসুদপায়হীন, নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা নিঃসন্দেহে একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং কাজ।

প্রথমেই আসে নানা দিক থেকে চাপের প্রসঙ্গ, যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে ভর্তি বাণিজ্য। ফন্দিবাজ নানা দল ও ব্যক্তি ভর্তি পরীক্ষায় চাপ দেওয়ার একটা সুযোগ খোঁজে। কখনো সফল হয়, কখনো হয় না। ভর্তি করানোর নামে বিভিন্ন পরিচয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগও পত্রিকায় পাতায় আসে। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় অসুদপায় অবলম্বনের বিভিন্নমুখী তথ্য পাওয়া যায়। কোথাও প্রশ্ন ফাঁস করা হয়, কোথাও অতি অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার করে উত্তর সরবরাহ করা হয়। সিট বণ্টন ও পরিদর্শনের শৈথিল্যের কারণেও কোথাও ভর্তি পরীক্ষার বিশুদ্ধতায় হানি ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাদের সঙ্গে আসা বাবা-মায়েদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা রাখতে হয়। সামগ্রিকভাবে ভর্তিযজ্ঞ সামাল দিতে সংশ্লিষ্টদের যেমন সতর্ক ও হুঁশিয়ার হতে হয়, তেমনিভাবে তাদেরকে অধিক পরিশ্রমও করতে হয়। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির নানা সুযোগ নিয়ে প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় বিপর্যয় ঘটানোর নানামুখী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক

প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, অবিতর্কিত পরীক্ষা সম্পন্ন করে প্রকৃত মেধাবীদের নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে সীমাহীন দায়িত্ব পালন করতে হয় ভর্তি সংশ্লিষ্টদের।

ভর্তি কার্যক্রমের দায়িত্ব পালনটি কেবল কঠিনই নয়, কখনো মনোযন্ত্রণাদায়কও বটে। কখনো দেখা যায়, পাঁচ বা দশ জন ছাত্র একই নম্বর পেয়েও আসন সঙ্কটের কারণে সবাই ভর্তির সুযোগটি পাচ্ছে না। আবার মাত্র এক বা আধা নম্বরের জন্য শত শত শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে। একই নম্বর পাওয়া বা মাত্র ১/২ নম্বরের বিবেচনায় মেধাবী-অমেধাবী নির্ধারণ করাটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। এমন কাজ কেবল কঠিনই নয়, মানবিক দিক থেকেও বেদনাজনক। ভর্তি কার্যক্রমে আসন স্বল্পতার কারণে এ রকম বহু বাস্তব সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয় সংশ্লিষ্টদের।

প্রসঙ্গত বলা ভালো, কেবল অধিক নম্বর প্রাপ্ত বিদ্যার্থী উৎপাদনই উচ্চশিক্ষার কাজ নয়। কিংবা এক টুকরা কাগজের নাম উচ্চশিক্ষা নয়। শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ ও দক্ষ, কর্মমুখী জনশক্তি করাই শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। শিক্ষার এই গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ দার্শনিক বক্তব্যকে বাস্তবায়িত করতে মেধাভিত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক-স্বচ্ছ ভর্তি কার্যক্রম একটি জরুরি পূর্বশর্ত। সৎ, পরিশ্রমী, আনন্দময় জীবন ধারণ করে উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করার প্রাতিষ্ঠানিক জরুরি কর্তব্য সম্পাদনের প্রথম ধাপই হলো ভর্তি পরীক্ষা। এখানে নজরদারি ও সতর্কতার প্রয়োজন সর্বাধিক। গোড়ায় গলদ হলে যেমন কোনো কাজই সঠিক হয় না, তেমনি ভর্তি পরীক্ষায় ক্রুটি থাকলে উচ্চশিক্ষার পরবর্তী পর্যায়গুলোও সুষ্ঠু হবে না। এ কারণেই

ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সকলের এতো উদ্বেগ ও আগ্রহ।

আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সব বিষয়েই ‘ফার্স্ট বয়’দের নিয়ে মাতামাতির আড়ালে বহু মানুষের ধারাবাহিক বঞ্চনার প্রতি ঔদাসীন্য যেন প্রতিষ্ঠানকে পেয়ে না বসে। বিষয়টি নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকেও পীড়া দিয়েছে, যা তিনি তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ-এ উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া, উচ্চশিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়ার পূর্বে আমাদের এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, শিক্ষা বর্তমান বৈশ্যযুগে বাণিজ্যিক বিপণনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং শিক্ষকরাও ছাত্রদের পাঠ-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে উদাসীন। এমন মনোভাব মোটেও কাঙ্খিত নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রমের সময় উল্লেখিত পটভূমিটিও মাথায় রাখতে হবে। মেধাবীদের ভর্তি করবো, এটা খুবই ভালো কথা। যারা ভর্তি হতে পারবে না, তাদেরতে ‘অমেধাবী’ সিল মেরে দেওয়াও ঠিক হবে না। অমেধাবী বা যারা সুযোগ পাচ্ছে না, তাদের জন্য কিছুই করবো না, এমন পরিস্থিতিও হতে দেওয়া যায় না। স্বল্প সংখ্যক আসনে অতি অল্পই ভর্তি হবে অত্যল্প আসন ও সুযোগের কারণে। বিপুল সংখ্যক যে ভর্তি হতে পারছে না, তাদের কথাও ভাবতে হবে। স্বল্প সংখ্যক মেধাবীকে সুযোগ দিয়ে বিশাল সংখ্যাকে বঞ্চিত ও অবজ্ঞা করার মাধ্যমে হতাশা ও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি যেন কখনোই সৃষ্টি না হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি অভিভাবকসমাজ ও সংশ্লিষ্টদের এসব কথাও ভাবতে হবে। নতুন সুযোগ ও ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে যুগের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে।

সামগ্রিকভাবে সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় ভাববেন বলেই সকলে আশা করেন। কারণ, বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে কিংবা অনাগতকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রয়োজনে, এমন কি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকসহ সার্বিক অগ্রগতির জন্য সকলের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা অত্যাবশ্যক। বিপুল জনশক্তিতে মানবশক্তি ও সম্পদে রূপান্তরের প্রধান হাতিয়ারও শিক্ষা। জাতীয় প্রয়োজন ও চাহিদাকে সামনে রেখে সবার জন্য শিক্ষার একটি সম্ভাব্য ছক অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে, যাতে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীরা যেমন উচ্চতর স্তরে পৌঁছুবে, তেমনি অন্যরাও যথাযথ স্থান ও সুযোগ বঞ্চিত হবে না। কাউকে বাদ দিয়ে, জায়গা দিতে না পেরে বা অমেধাবী বলে সরিয়ে রাখা হবে না।

বাংলাদেশে বিরাজমান যুদ্ধংদেহী ভর্তি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগ বৃদ্ধি ও বিকাশের চেতনা সবার মধ্যেই আসা অপরিহার্য। পাশাপাশি এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ভর্তি যুদ্ধ যেন রণাঙ্গণের মতো না হয়ে অ্যাকাডেমিক থাকে, সকলের জন্য যেন কম বা বেশি উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকে এবং অসুদপায়ের মাধ্যমে যেন প্রকৃত মেধাবীদের বঞ্চিত না করা হয়। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িতদের কাছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এটাই কামনা করেন।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003619909286499