হোসনে আরা ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের চরম কশাঘাতে বেড়ে উঠেছে। পরিবারের কর্তা হলেও তার বাবা কখনও তাদের পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করেনি। তাই বাধ্য হয়ে তার মা দিনমজুরি করে সংসার চালাত। হোসনে আরা কখনও কল্পনা করতে পারত না সে স্কুলে যাবে কিংবা পড়ালেখা করে ভবিষ্যতে চাকরি করবে! তার মা যখন কাজে যেত সারাদিন সে ঘরের কাজ করত এবং ছোট বোনকে দেখাশুনা করত। এভাবেই কাটছিল হোসনে আরার জীবন। একদিন তার মা এক প্রতিবেশীর সাহায্যে আন্ডার প্রিভিলেজড চিলড্রেন’স এডুকেশনাল প্রোগ্রাম (ইউসেপ) এর স্কুলে খোঁজ নেয়ার পর সেখানে মেয়েকে ভর্তি করেন। হোসনে আরা যখন এসএসসি পাস করল তারপর সে ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে সে সেলাইয়ের কাজ শিখল। হোসনে আরা তার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদিন পরেই সে একটি গার্মেন্টসে মাসিক ৮ হাজার ৮ শ’ টাকা বেতনে চাকরিও পেয়ে গেল। হোসেনে আরার মতে, ‘ইউসেপ থেকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই আমি আজ স্বাবলম্বী। আমি ভবিষ্যতে আরও পড়ালেখা করতে চাই এবং নিজ যোগ্যতায় ভাল চাকরি পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
হোসনে আরার মত অনেক নারীই বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। সাধারণ শিক্ষায় এগিয়ে থাকলেও কারিগরি শিক্ষায় এক সময় নারীরা ছিল অনেকটাই পিছিয়ে। ধীরে ধীরে কারিগরি শিক্ষাতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ইউসেপ বাংলাদেশ জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ। বিগত সাত বছরে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ১ থেকে ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করতে নারীরা এখন ধীরে ধীরে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। পড়াশোনার খরচ কম হওয়ায় কিংবা দীর্ঘ বিরতির কারণেও অনেকে ভর্তি হচ্ছে কারিগরি শিক্ষায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, উপযোগী কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এ বিষয়ে ইউসেপ বাংলাদেশের টেকনিক্যাল স্কুলের প্রধান দ্বীন মোহাম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষায় আগের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে কারিগরি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ ও অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে দক্ষ নারী কর্মজীবী তৈরিতে নারীবান্ধব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবেশ গঠন জরুরী। এতে কর্মমুখী এই শিক্ষা নারীদের কর্মক্ষেত্রে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
সরকারের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন (২০১৬-১৭) তথ্যমতে, বর্তমানে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মোট ৮ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ২ লাখ ৮ হাজার ৮৭০। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় ছয় হাজার। এর মধ্যে সরকারী প্রতিষ্ঠান ২৮৮। এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রায় নয় লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী দুই লাখের কিছু বেশি। কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এ ক্ষেত্রে মোট শিক্ষার্থীর ৩৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।
এর বাইরে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২১ দশমিক ১৯, গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটে ৯ দশমিক ৯৩, মেডিক্যাল টেকনোলজিতে ৩১ দশমিক ৬০, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ৭ দশমিক ৮১, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ২১ দশমিক ৫১ ও মেরিন টেকনোলজিতে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী রয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরে ফারিয়া আক্তারের বাস। তিনি কেক, পেস্ট্রিসহ কনফেকশনারি সামগ্রী তৈরি করে নিয়মিত বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন। এতে তার মাসিক আয় হয় প্রায় দশ হাজার টাকা। ফারিয়ার মত আফরোজা ও রতœা বাসায় বসে সেলাই ও এমব্রয়ডারি কাজের অর্ডার নিয়ে তা দোকানে সরবরাহ করে মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা রোজগার করেন। একইভাবে তাহমিনা বিউটি পার্লারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজে পার্লার খুলেছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি বেশকিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন এবং সংসারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল রাখতে ভূমিকা রাখছেন। ফলে পরিবারে ও সমাজে তাদের গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে গেছে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বেড়ে যাচ্ছে। এরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্ব-স্ব ভাগ্যের উন্নতি সাধন করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নানান কর্মসূচী হাতে নিয়েছে সরকার। সরকারের প্রণীত কৌশল অনুযায়ী, ভর্তির হার ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ১৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ২০ দশমিক ৮২ শতাংশে উন্নীত করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক (প্রকাশনা) মোদাচ্ছের আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কারিগরি শিক্ষায় নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা এখন লেখাপড়া শেষ করেই কাজ পেয়ে যাচ্ছে। আর তাই এ শিক্ষার প্রসার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত সাড়ে সাত বছরে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষার আওতায় চলে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষায় উৎসাহিত করতে পূর্বে ৪৯ সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হতো, যা পরে ২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ফলে বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীর সংখ্যা নির্ধারিত ২০ শতাংশ কোটা অতিক্রম করেছে। সরকারী-বেসরকারী মিলে ১৬৩ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীদের সরকার প্রতি মাসে ৮শ’ টাকা করে বৃত্তি প্রদান করছে।’
বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় নারীর আগ্রহ বাড়লেও সেই তুলনায় ভর্তির সুযোগ সীমিত। সরকারীভাবে ছাত্রীদের জন্য শুধু ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় চারটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ফলে প্রতিবছর জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যতসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছে, তাদের খুব কমই কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারীভাবে এরই মধ্যেই আরও তিনটি ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।