মডেল স্কুল জাতীয়করণ : তেলা মাথায় তেল - Dainikshiksha

মডেল স্কুল জাতীয়করণ : তেলা মাথায় তেল

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এমনিতেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নানা বৈষম্যের পাহাড়। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর বৈষম্যের কষাঘাতে জর্জরিত আজ। এখানে সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, এমপিওবিহীন, স্বীকৃতি প্রাপ্ত, অনুমতিপ্রাপ্ত ও অনুমতিবিহীন নানা জাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আবার অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান আছে , যেখানে বহু সংখ্যক এমপিওবহির্ভূত শিক্ষক । এসব প্রতিষ্ঠানে ‘কেউ খাবে, কেউ খাবে না’ অবস্থায় বৈষম্যের এক জলজ্যান্ত নজির। আইসিটির যুগে আইসিটি’র শিক্ষকরা উপোস । কবি সুকান্তের কবিতার অমর পংক্তিগুলো অহর্নিশ ঘোরপাক খায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের আঙ্গিনা জুড়ে-

‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,

পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি । ‘

বৈষম্যমূলক শিক্ষা মানসম্মত শিক্ষার প্রধান অন্তরায় । আমাদের শিক্ষা আজ পণ্যে রুপান্তরিত । শিক্ষা বাণিজ্য আজ অনেকের কাছে একটি লাভজনক ব্যবসা । অনেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে শিক্ষার নামে । ইংলিশ মিডিয়াম তথা শহরের নামীদামী অনেক প্রতিষ্ঠানে নানা ভাবে চলছে শিক্ষার নামে হরেক ব্যবসা । ফলে আমাদের শিক্ষা আজ নিজের গতিপথ হারিয়ে অনেকটা লক্ষ্যচ্যূত হয়ে পড়েছে ।

অনিয়ন্ত্রিত কোন কিছুই মঙ্গলজনক হতে পারে না । শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উপর সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত না হলে শিক্ষায় বাণিজ্য কোনদিন বন্ধ হবে না । আর শিক্ষার যে কোন স্তরের উপর সরকারি তত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ জাতীয়করণের অন্য কোন বিকল্প নেই ।

আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে জাতীয়করণ করেছিলেন বলেই আজ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর কেবল সুনিয়ন্ত্রিত নহে , এ স্তরটি আজ শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে । প্রাথমিক শিক্ষায় আজ গতি সঞ্চার হয়েছে । উচ্চ শিক্ষিত ও মেধাবীরা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন । অনেকে সেকেন্ডারি ছেড়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে উৎসাহী হচ্ছেন । পিএসসির মতো একটি বড়ো মাপের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারছে আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা ।

শিক্ষায় বৈষম্য কারো কাম্য হতে পারে না । সর্বপ্রথম বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ইংরেজরা বৈষম্যমূলক শিক্ষা প্রবর্তন করেছিল । ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল তাদের । তারা ‘ভাগ করে শাসন করা’র ( divide & rule) নীতিটি সফল ভাবে চালাবার জন্য তা-ই করেছিল । তারা কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা সহ কয়েকটি মাদ্রাসা সরকারিকরণ করেছিল এবং স্থানে স্থানে তাদের তাবেদার গোষ্ঠীকে খুশী করার জন্য কিছু কিছু স্কুল কলেজ সরকারি করেছিল । বঙ্গবঙ্গ রদ হলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের খুশী করার জন্য তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিল । এভাবেই ইংরেজ শাসনামলে উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বৈষম্যের নানা বীজ রুপিত হয় ।

স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈষম্যহীন এক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন । শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ করেন । আজকের মতো সেদিনের অর্থনৈতিক অবস্থা হলে বঙ্গবন্ধু হয়তো গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই জাতীয়করণ করে ফেলতেন । কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটির চল্লিশ বছর পর এসে ও পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা দূরে থাক ,দ্বিতীয় ধাপ বা স্তর হিসেবে কেবল মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি জাতীয়করণের সাহসটুকু আজ পর্যন্ত আর কেউ দেখাতে পারেননি ।

গোটা মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ না করে ও প্রায় সকল সরকারই একটা- দু’টো করে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল সরকারিকরণ করেছে । কোন নীতিমালা ছাড়াই এসব বেশীরভাগ স্কুল সময়ে সময়ে সরকারি হয়েছে । কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ সকল প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয় । কোন কোন দাপুটে নেতা নিজের এলাকায় সময়ে সুযোগে এক- দু’ টো স্কুল জাতীয়করণ করিয়ে নিয়েছেন । এভাবেই আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষায় বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্ঠি হয় এবং নীতি বহির্ভুত ভাবে কিছু কিছু স্কুল কলেজ সরকারিকরণ হয় । দু’- চারটে হয়তো নীতিমালার আলোকেই হয়েছে । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নীতি মানা হয়নি।

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করায় তাঁর কন্যার প্রতি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা জাতীয়করণ বিষয়ে দেশবাসীর প্রত্যাশা একটু বেশী। শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর জাতীয়করণ হবে- এমন একটা প্রত্যাশা নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে অনেকেই পোষণ করে আসছেন । দলমত নির্বিশেষে সকলেই এ রকম একটি স্বপ্ন দেখে আসছিলেন । শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সে প্রত্যাশা আরো সুদৃঢ় হতে থাকে । বিশেষ করে শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নানামূখি উদ্যোগ সে আশাকে আরো বাড়িয়ে দেয় ।

সদ্য বিদায়ী শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান ( এন,আই খান ) জননেত্রি শেখ হাসিনার সাথে বিদায়ী সাক্ষাত কালে বিদায়ী সচিবকে ‘এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণে অতিরিক্ত কত টাকা প্রয়োজন ‘ – মাননীয় প্রধানমন্ত্রির এমন প্রশ্ন করার খবরটি বহুল পঠিত দৈনিকশিক্ষাডটকমে প্রকাশিত হলে সারা দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় । জায়গায় জায়গায় তাঁরা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ উল্লাস করেন । ভেতরে ভেতরে সে আনন্দের জোয়ার এখনো বইছে তাঁদের হৃদয়ে- অন্তরে ।

ভিন্ন আরেক খবর । সরকার দেশের ৩১৫ টি মডেল স্কুলকে নাকি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয়করণ করতে যাচ্ছে । মডেল স্কুল জাতীয়করণে কারো আপত্তি থাকার কথা নয় । আপত্তি হলো, ভেঙ্গে ভেঙ্গে বা একটা- দু’টো করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা ।

মডেল স্কুলসমূহ উপজেলা সদরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । তাদের তহবিল অনেক সমৃদ্ধ । বেশীর ভাগ মডেলের শিক্ষক- কর্মচারীগণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- কর্মচারীদের ন্যায় বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন । তাদের শিক্ষার মান অনেক ভাল । স্বচ্ছল ও শিক্ষিত মা- বাবার সন্তানরা এ সকল স্কুলে পড়াশুনা করে । অবকাঠামোগত সকল সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান । মডেল প্রকল্পের আওতাভুক্ত হবার পর থেকেই তাদের খেলার মাঠ , লাইব্রেরি , কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞান ভবন , মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম-এক কথায় পড়াশুনার মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে । প্রয়োজনে অতিরিক্ত মানসম্মত শিক্ষক সংগ্রহ করা ও তাদের জন্য কষ্টকর নহে ।

পক্ষান্তরে গ্রাম পর্যায় বা মফস্বলের স্কুলগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ । নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এরা । অভিজ্ঞ শিক্ষকের খুবই অভাব । বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকের আকাল । তহবিলের অবস্থা ও খুব করুণ । ফি বছর ডেস্ক- বেঞ্চসহ নানা আসবাবপত্র নির্মাণ ও পার্ট টাইম শিক্ষকগণের বেতন পরিশোধ করে এদের তহবিলে তেমন টাকা পয়সা থাকে না । বেশীর ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান । এরা লেখাপড়ায় এমনিতেই দূর্বল । অনেকের মা- বাবা লেখাপড়া জানেন না । এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে , যারা তাদের শিক্ষক- কর্মচারীদের সরকারি বেতনের বাইরে আর কিছু দিতেই পারে না।

এমতাবস্থায় জাতীয়করণের জন্য কেবল মডেল স্কুলগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদানের হেতু অনেকের বোধগম্য নহে । মডেল স্কুল গুলো সহ মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে কিংবা এক সাথে জাতীয়করণ করলে আমাদের শিক্ষায় নব দিগন্তের উন্মেষ ঘটবে । এ জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে ।

দেশ এখন মধ্যম আয়ের কাছাকাছি । মাধ্যমিক শিক্ষা উচ্চ শিক্ষার ভিতকে সুদৃঢ় করে নানামূখি গবেষণা ও আবিস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যায় । তাই মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের সকল প্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ।এটিই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী । কেবল আংশিকভাবে কতকগুলো স্কুল জাতীয়করণ কিংবা শুধু মাত্র মডেল স্কুলগুলো জাতীয়করণ করলে শিক্ষায় বৈষম্য আরেক ধাপ বেড়ে যাবে ।

শিক্ষাবান্ধব এ সরকার মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক সাথে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়ে জাতির জনকের পদাংক অনুসরণ করবে- সে প্রত্যাশা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের । তবে এ স্তরের এমপিও বহির্ভূত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের আরো আগে এমপিও’ র আওতায় নিয়ে আসা উচিত । দেশ ও জাতির স্বার্থে এ নিয়ে আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073390007019043