মায়ের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের অনেক দিনের দাবি। এ প্রেক্ষিতে চলতি বছর পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় পড়াশোনার উদ্যোগ নেয় সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা এবং সমতলের গারো, সাঁওতাল এ পাঁচটি নৃৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার পাঠ্যবই ছাপিয়েছে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম বোর্ড। কিন্তু শিক্ষক সঙ্কট, পাঠ্যবই স্বল্পতা এবং পাঠদানের সময়সূচি সম্পর্কে কোনো সঠিক নির্দেশনা না থাকায় বান্দরবানে পাঠদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আটটি গোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে।
বান্দরবানের পাড়া প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উসংনু মারমা বলেন, আমার বিদ্যালয়ে মাত্র চারজন মারমা শিশু প্রাক-প্রাথমিকের ছাপানো পাঠ্যবই পেয়েছে। অন্য শিশুরা কখন বই পাবে, তাও জানি না। মাতৃভাষায় শিশুদের বই দেওয়া হলেও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়াও কোন সময়ে শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করানো হবে সে সম্পর্কেও কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যে কারণে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
পাবলা হেডম্যানপাড়া কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আদী ম্রো এবং চামলেন ম্রো বলে, আমরা মায়ের ভাষায় লেখাপড়া শিখতে চাই। আমাদের ম্রো ভাষায় বই দরকার। সরকার আমাদের বই ছাপিয়ে দিলে আমরাও মাতৃভাষায় শিখতে পারবো। এটি সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
২০০৬ সালে উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় বেসরকারি পর্যায়ে মাতৃভাষা ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক স্কুল চালু হয়। তবে চলতি বছর থেকে সরকারিভাবেই প্রাথমিকে মাতৃভাষায় লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ভাষার শিশুদের জন্য দুটি করে বই ছাপানো হয়েছে। যা ইতোমধ্যে শিশুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। তবে বান্দরবানের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি স্কুলের মুষ্টিমেয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশু ছাড়া অধিকাংশই শিশুই কোনো পাঠ্যবই পায়নি। যারা পেয়েছে তাদেরও মাতৃভাষায় পাঠদান আরম্ভ করা যায়নি সরকারি স্কুলগুলোতে নানা প্রতিবন্ধকতায়।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য , লেখক ও গবেষক সিইয়ং ম্রো বলেন, ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা বাড়িতে মায়ের ভাষায় কথা বললেও স্কুলে গিয়ে শিশুদের বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। স্কুলে ভিন্ন ভাষায় লেখাপড়া শেখা কঠিন হচ্ছে পাহাড়ি শিশুদের। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা বাংলা বোঝে না, তাই লেখাপড়ার প্রতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের আগ্রহ কম। মায়ের ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পেলে শিশুরা সহজে গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু পাশাপাশি বাংলাসহ অন্যান্য ভাষাও থাকতে হবে। তবে আমরা আশাবাদী সরকার যেহেতু পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যবই ছাপিয়ে মাতৃভাষায় শেখার উদ্যোগ নিয়েছে সেহেতু পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী শিশুদের মায়ের ভাষায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খুমী লেখক ও গবেষক সি অং খুমী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে আটটির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। কিন্তু খুমী শিশুরা বর্ণমালা থাকার পরও মায়ের ভাষায় লেখাপড়া শেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। সরকার পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতির মতো অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী শিশুদেরও মাতৃভাষায় পড়াশোনা শেখার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং বলেন, সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে মাতৃভাষা শিক্ষা কোর্স কার্যক্রম চালু হয়। ধারাবাহিকতায় মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খুমী ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। অন্য জাতিগুলোরও বর্ণমালা, ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করছে সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রিটন কুমার বড়ুয়া জানান, জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনো মাতৃভাষায় ছাপানো প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের পাঠ্যবইগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায়নি। তবে মারমা ভাষায় প্রায় আটশ বই পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সাত উপজেলায় একশ করে সাতশ বই পাঠানো হয়েছে। মাতৃভাষায় লেখাপড়া শেখানোর জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বই স্বল্পতার কারণে স্কুলগুলোতে মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুত চালু করা হবে।