রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গত ২৬ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞগন বিভিন্ন ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন।
শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝেন না। তারা জানেন না কীভাবে পড়াতে হবে। কীভাবে প্রশ্ন করতে হবে। সেজন্য সৃজনশীল পদ্ধতিও ফিরে যাচেছ আগের যুগের গাইড বইয়ের দিকে। অভিভবাকরা ছুটছেন কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট টিউটরের কাছে।’একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ব্যাংক করার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে অসংখ্য প্রশ্ন থাকবে। শিক্ষকরা সৃজনশীলতাকে বুঝতে পারবেন। পড়াতে পারবেন। প্রশ্নও করতে পারবেন। এ প্রশ্ন ব্যাংকটি থাকবে সবার জন্য উন্মুক্ত। এখান থেকেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসবে।
এর ফলে শিক্ষার্থীরা দিক নির্দেশনা পাবে। ’ তবে কেন্দ্রীয় প্রশ্নব্যাংকের কথা মনে আসলেই আমাদের সেই তথাকথিত এমসিকিউ-এর প্রশ্নব্যাংকের কথা মনে করিয়ে দেয়। সরকার এমসিকিউ প্রশ্নের মান আগামী বছর থেকে ১০ কমাবে। এখন প্রতিটি বিষয়ে ৬০ নম্বর থাকে লিখিত পরীক্ষার ওপর, আর ৪০ নম্বর থাকে এমসিকিউ। এই নম্বর পর্যায়ক্রমে শূন্যে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞগন। এরশাদ আমলে যখন মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) চালু করা হয় তখন শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করে এক হাজার নম্বরের মধ্যে ৭’শ, ৮’শ এবং ৯’শ বা তারও বেশি নম্বর পেতে শুরু করল। এমসি কিউ চালুর আগে যারা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করতো তারা ৭’শ, ৭’শ ৫০ ও ৮’শ নম্বর পাওয়া শুরু করল। ফলে শিক্ষার্থীর প্রকৃত মান বুঝতে পারাটা কঠিন হয়ে পড়ল।
অথচ তার আগে যারা প্রথম বিভাগে পাশ করতো তাদের একটি মান ছিল এবং সবাই প্রথম বিভাগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সেভাবেই দেখতেন ও বিচার করতেন। তাদের চেয়ে যারা আরও ভাল তারা পেত ষ্টার মার্কস অর্থাৎ ৭’শ ৫০ বা ততোধিক নম্বর। কিন্তু এমসিকিউ চালুর পর যখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী ৭’শ, ৮’শ ও ৯’শ নম্বর পাওয়া শুরু করলো তখন থেকেই পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের দিকে মানুষের দৃষ্টি আর সেভাবে আকৃষ্ট হতো না। নম্বরের ভিত্তিতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের গ্রেড দেওয়া হতো তাই প্রকৃত মেধাবীদের বের করা কষ্টকর হলো। সেই ধারা এখনও চলছে। শুধু নম্বর পাওয়ার ছড়াছড়ি।
আরো মজার ব্যাপার হলো, সব প্রশ্নই আসতো নির্দিষ্ট সংখ্যক তথাকথিত প্রশ্নব্যাংকের ৫’শ প্রশ্ন থেকে। শিক্ষার্থীরা বই পড়া বাদ দিয়ে প্রশ্নব্যাংক পড়া শুরু করলো। করার তো কথাও তাই। যেহেতু তাদের প্রশ্ন ওই ৫’শটি থেকেই আসবে, তারা বই পড়ে অযথা সময় নষ্ট করবে কেন? সেই ধারা এখনও বর্তমান আছে। অনেক লেখালেখি, আলোচনা ও সমালোচনার পর প্রশ্নব্যাংক তুলে দেওয়া হলো কিন্তু তার স্থান দখল করলো ‘নোট ও গাইড বই’। তবে এম সি কিউ তুলে দেওয়া হলোনা। নম্বর ৫০ থেকে নামিয়ে ৪০ করা হলো।
বর্তমান সরকার এটিকে ৩০ করতে চাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে, এটি ভাল দিক। কারণ এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা দেখাদেখি করে ও আলোচনার মাধ্যমে দেয়, কাজেই কোন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বুঝা যায় না। তাছাড়া চারটি প্রশ্ন দেয়া থাকে আন্দাজে টিক দিলেও পাশ নম্বর উঠে যায়, শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের চিন্তা করতে হয়না, নিজেদের কোন বিচার-বিবেচনা বা মতামত প্রকাশ করার সুযোগ নেই এমসিসিউতে। এমসিকিউ প্রশ্নে বিশ্লেষণমুলক কিছু থাকেনা ফলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হওয়ার পথে এটি একটি অন্তরায়। কাজেই বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই তবে প্রশ্নব্যাংকে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝার জন্য শিক্ষকদের প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে, তাদেরকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাছাড়া বেশ কিছু মডেল উন্মুক্ত রাখতে হবে যাতে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই সহজেই সেগুলো দেখতে পারে ও শিখতে পারে। কিন্তু প্রশ্নব্যাংক করাটা বোধ হয় ঠিক হবেনা।
ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘পাঠ্যবই সহজ হওয়া উচিত। যাতে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে। শিক্ষকরা না পড়ালেও যেন তারা নিজে নিজে পড়ে বুঝতে পারে। আমাদের বই লেখার পদ্ধতি ভালনা। নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের বই আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। বাচ্চারা কিভাবে বুঝবে? বই যত্ন সহকারে তৈরি করতে হবে। ভালভাবে বই ছাপালে এক বই ৭/৮বছর ধরে পড়ানো যায়। কর্র্তৃপক্ষ চাইলে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ণের কাজটি করতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘এমসিকিউ তুলে দেওয়া উচিত। এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।’
ইষ্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘কারিকুলাম ভারী হয়ে গেছে। নবম শ্রেণির পড়া, একাদশে আবার অনার্সে পড়ানো হচেছ। এতে করে এক পড়া তিন চার জায়গায় পড়ানো হচেছ।যার কোন প্রয়োজন নেই। বেসিক বিষয়গুলো যুক্ত করে বাড়তি বিষয় বাদ দেওয়া উচিত। তিনি এমসি কিউ পদ্ধতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা উচিত বলে মনে করেন।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘চমৎকার পাঠ্যবই তৈরি করতে হবে। ভাল প্রশ্ন করতে হবে। মূল্যায়ণ ব্যবস্থা ভাল করতে হবে। আমাদের পাঠ্যবই কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেনা। না বিষয়ের দিকে দিয়ে, না বইয়ের পাতা, প্রচছদ ও ছবি। এ নিয়ে বহু কথা হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি কারণ সরকার ব্যস্ত থাকে বত্রিশ/তেত্রিশ কোটি বই ছাপাতে। বই ছেপে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে সমস্ত শিক্ষা প্রশাসন ও সরকারি বিশেষজ্ঞগন। বইয়ের কোয়ালিটি আর বিষয় নিয়ে তাদের ভাববার সময় কোথায়? তারপর মূল্যায়ণের কথায় যদি আসি মূল্যায়ণ কি ঠিকভাবে হচেছ?
যারা পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র মূল্যায়ণ করেন তাদের কজন সে কাজটি করতে উপযুক্ত? সরকার প্রতিবছরই তাড়াহুড়ো করে উত্তরপত্র মুল্যায়ন করিয়ে থাকে, ফলে প্রতিবছরই ফলাফলে মারাত্মক বিভ্রাট ঘটে। উত্তরপত্র পরীক্ষণকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষন ও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন এর কোনটিই মানা হয়না। শুধু তাড়াহুড়ো করা চলে এসব ক্ষেত্রে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা জিডিপির অন্তত চার শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দের কথা বলেছিলাম, কিন্তু জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ কমে ১ দশমিক ৮ এ চলে এসেছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি কোন কাজ করেনা অথচ তারা অনেক টাকা খরচ করে নির্বাচন করে। এ বিষয়টি ভাবতে হবে। পাঠ্যবইয়ে যাতে ভুল না থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।’
ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তারা যেভাবে স্কুল চালাতে চান, স্কুল সেভাবে চলছে। সেখানে কোয়ালিটির প্রশ্ন অত্যন্ত তুচ্ছ। কে দেখবে এসব? তবে সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন করা হলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন এক্ষেত্রে আসতে পারে। তবে, প্রশাসন দলীয়করণের কারণে এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দৌরাত্বের কারণে সেটা কতটা সম্ভব হবে তা সময়ই বলে দিবে।
এই মতবিনিময় সভার অনেক আলোচনার মধ্যে দুটি বিষয় আমাদের চিন্তার খোরাক যোগায় সবচেয়ে বেশি। তার একটি হচেছ ড. জাফর ইকবালের একটি উক্তি যা তিনি করেছেন তার ‘সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে কিছু কথা’ শীর্ষক একটি লেখায়। তিনি ওই মতবিনিময় সভার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁদের মাঝে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের শিক্ষকরাই বেশি ছিলেন, মাঠপর্যায়ের স্কুলের শিক্ষকরা কেউ ছিলেন না। তাই আলেচনাটুকু ঠিক বাস্তবমুখী না হয়ে অনেকটা দার্শনিক আলোচনার মতো হয়েছিল।’ স্যারের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত।
এ ধরনের যে কোন সভা-সেমিনারে দেখা যায় শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর উচচ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদেরকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। যারা মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত, এ নিয়ে গবেষণা করেন, মাঠ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন, কাজ করেন, এ নিয়ে সর্বদাই চিন্তা ভাবনা করেন তারা এসব সভা-সেমিনারের ধারে কাছেও নেই। হাঁ, বিশ্ববিদ্যালেয়র শিক্ষকদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও নির্দেশান অনেকটাই এখানে কাজে লাগবে কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি বিষয় কি তাদের জানা আছে? থাকার কথা নয় দু চারজন ছাড়া।
তারা কিছু তাত্তিক কথা বলবেন, ভাবের কথা বলবেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাস্তব শ্রেণিকক্ষের সাথে তাদের যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা নেই। কাজেই মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে যারা সরাসরি জড়িত তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে এসব সভা-সেমিনারে, এধরনের যে কোন কর্মকান্ডে। সম্পৃক্ত করতে হবে মাধ্যমিকের সরাসরি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে।
তাদের কথা শুনতে হবে। অনেক শ্রেণিকক্ষ সরাসারি পর্যবেক্ষন করতে হবে সিটি, শহর ও গ্রামের স্কুলগুলোর। এ ধরনের সেমিনার প্রতিটি বিভাগে এবং বড় বড় কয়েকটি জেলায় অনুষ্ঠিত হলে অনেক পাঠপর্যায়ের প্রকৃত শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। দ্বিতীয়টি হচেছ একজন প্রধান শিক্ষকের উক্তি।
উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘যে স্কুল কোচিং করতে ও গাইড বই পড়তে দেয়না সেখানে ছাত্র আসেনা। এখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা স্কুল বন্ধ করে কি কোচিং খুলব না কি মূল বই বন্ধ রেখে গাইড চালূ রাখবো?’
শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী কথার মধ্যেই উঠে এসেছে যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কত বড় ব্যাধিতে আক্রান্ত। এর আসল কারণগুলো বের করতে হবে, দিতে হবে সঠিক ঔষধ আর তার জন্য খুঁজতে হবে প্রকৃত ডাক্তার।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।