আমাদের দেশে মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ-দ্বাদশ) ৯৭ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যবস্থাপনানির্ভর। এই স্তরে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি- এই চার ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা রয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে নির্দিষ্ট শর্ত মেনে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আয়োজন সম্পন্ন করার পর সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রাথমিক অনুমতির জন্য পরিদর্শনের আবেদন করা হয়। এরপর প্রাথমিক অনুমতি মিললে নিয়মমাফিক কয়েকটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি পায়। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে এটাই রীতি। সরকারি উদ্যোগে জমি কিনে এবং অবকাঠামো নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের প্রয়োজন পড়ত।
বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি এবং এমপিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আন্দোলন করছে। প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে এই স্তরে অভিন্ন নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাথমিক শিক্ষার মতো অভিন্ন নিয়ম-নীতির ভিতর আনা প্রয়োজন। বহু বছর ধরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গভীর সংকটের ভিতর রয়েছে। সে কারণে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরুরি ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করে পরবর্তী ধাপে জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করাই হবে সমীচীন।
মাধ্যমিক স্তরের সরকারি, এমপিওভুক্ত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই নিয়ম-নীতিতে পরিচালিত হয়। একই কারিকুলাম, সিলেবাস ও প্রশ্নপদ্ধতি অনুসরণ করে। শিক্ষার্থীরা বোর্ড থেকে একই মানের সনদ পায়। যে কারণে স্বীকৃতির সময় থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন হওয়ার কথা। অথচ দীর্ঘ ১৫-২০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও একটা বড় সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন না পাওয়ায় একদিকে মানসম্মত পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে ১৫ লাখের ওপর শিক্ষার্থীর পাঠদানকারী শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে অর্থ সংকটের কথা বলা হয়। এখন কোনো একটি খাতে বরাদ্দ না দিলে অর্থ সংকট তো হবেই। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতি অনুযায়ী জিডিপির অন্তত ৬ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকার কথা। সে ক্ষেত্রে এ দেশে এই বরাদ্দ মাত্র ১.৮ ভাগ। আর বাজেটের ২০ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকার কথা থাকলেও সেখানে এ বরাদ্দ থাকে মাত্র ১১ ভাগ। শিক্ষা খাতে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ থাকলে অর্থ সংকটের প্রসঙ্গ আসত না। শিক্ষার শক্ত ভিত্তি ছাড়া বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনকে সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে এ সংখ্যা ৩ হাজারের মতো। দেশে মোট এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২৭ হাজার। আর এমপিওভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৫ হাজারের উপরে। সব মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৩২ হাজার। দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ ভাগ। যথাযথ পরিদর্শন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও রয়েছে। শিক্ষা বোর্ড অথবা ডিডিপিআই শর্তপূরণ না হওয়ার দরুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি না দিলে মন্ত্রণালয় থেকে শর্ত শিথিল করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মূলত চারটি কারণে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রথমত, গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করাকে মর্যাদার বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কোনো এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিলে এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তখন দু’পক্ষই দেনদরবার ও অর্থব্যয় করে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন করিয়ে এনেছে। অথচ ওই জনপদে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন হওয়াটাই ছিল সমীচীন। দ্বিতীয়ত, কেবল মেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয়, মহিলা কলেজ কী মহিলা মাদ্রাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী সহশিক্ষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব বিবেচনা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে কেবল এক বালিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য বালিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্বের হিসাব কষা হয়। অথচ ওই এলাকায় সহশিক্ষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েরাও লেখাপড়া করে। বর্তমানে সমাজব্যবস্থা আগের মতো রক্ষণশীল নয় যে কেবল মেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের আবশ্যকতা রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যাবে, মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-স্বল্পতা বিরাজ করছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক বিবেচনায় শর্ত শিথিল করে অনুমোদন দেয়ায় অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা, বিশেষত সংসদ সদস্যরা নিজ নামে কিংবা নিজের মা-বাবার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে মন্ত্রণালয় থেকে দূরত্বের শর্ত শিথিল করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন নেয়া হয়েছে। যারা আইন প্রণয়ন করেছেন তারাই আবার সেই আইন মানেননি। চতুর্থত, উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের কাজটা সহজ নয়। দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি এদের পেশার অন্যতম ক্ষেত্র। এলাকাবিশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীরা ডোনেশন দিয়ে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। এ ধরনের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ার একটা কারণ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকারের উচ্চমহল অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ব্যাপারে দ্বিধায় রয়েছে। যে কারণে অনেক আশ্বাস ও প্রতিশ্র“তির পরও বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকে অথচ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এমপিওভুক্তি চলমান প্রক্রিয়া। এ স্ববিরোধিতা আমাদের বিস্মিত করে। একই যাত্রায় এমপিওভুক্ত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’ধরনের ফলভোগ করছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শতভাগ বেতন পাচ্ছে অথচ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো বেতনই পাচ্ছেন না। আমরা একই পরিবারের সদস্য- শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের সহানুভূতি নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো শোনায়। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দকে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের জন্য লড়াই করছি। অথচ বাস্তবে এর কোনো ফলাফল মেলে না। তার এই উক্তি কথার কথা হয়ে দাঁড়ায়।
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বিবেচিত হলে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবলোপন করা যেতে পারে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করতে পারে না, ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবলোপন করা সঙ্গত। বর্তমানে অনলাইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। কোনো কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন জমা না পড়লে সেই কলেজ অবলোপন করা যেতে পারে। আবার শিক্ষকের সংখ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যার অধিক হয়ে দাঁড়ালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকে থাকার কারণ নেই। তবে অবলোপন প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আগে এমপিওভুক্ত করে একই পর্যায়ে আনতে হবে। এরপর শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি বদলির চাকরিতে পরিণত করতে হবে। অতিরিক্ত বিবেচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব শিক্ষক-কর্মচারী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলি করলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবলশূন্য হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হবে। এইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে সুষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা থাকা দরকার। দীর্ঘদিন বিনা বেতনে পরিচালিত হওয়ার দরুন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার ওপর এমপিও, নন-এমপিও নির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগরীতি চালু হওয়ায় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংকট আরও বেড়েছে। কারণ সরকারি নিয়োগরীতি অনুসরণ করে কেইবা আর বিনা বেতনে চাকরি করতে চায়! একদিকে বিনা বেতন, অন্যদিকে শিক্ষকস্বল্পতার কারণে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই করার জন্য এমপিওভুক্তির পর অন্তত ৩ বছর সময় দেয়া দরকার। এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকার মতো যোগ্যতা রাখে কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হবে। তখন টিকে থাকার যোগ্যতা না রাখলে ওইসব প্রতিষ্ঠান অবলোপন করা যেতে পারে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিলোপ সাধন ও সুষম বিন্যাস সম্ভব।
বর্তমানে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারী ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শূন্যপদ রয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির পর শিক্ষক-কর্মচারী বদলি এবং অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবলোপনের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় সুস্থিতি আনা সম্ভব।
শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক
সৌজেন্য: যুগান্তর