স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা আজও যেন দুঃস্বপ্ন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় শীর্ষক এক সেমিনারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষার হতাশ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন জাতির চাহিদা অনুসারে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। অন্যতম চ্যালেঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষকেরা। অনেক শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ কম। যার ফলে জাতির মেরুদন্ড সোজা হচ্ছে না। তিনি শিক্ষকের এ পেশায় অধিকতর মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ দূর না করে শুধু আহ্বান জানানো অনেকটা পানিবিহীন চিড়া ভেজানোর প্রবাদের মতো। প্রাথমিক শিক্ষকের মানোন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো উপড়ে ফেলার জন্য শিক্ষক, মাননীয় মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য কেবল যেখানে-সেখানে বুলি আওড়ানো বক্তব্য পরিহার করে কার্যকর উদ্যোগ আজকের বাস্তবতা। এ উপলদ্ধিবোধ থেকে চ্যালেঞ্জসমূহ উপস্থাপন করছি।
১. প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতাবিহীন প্রশাসন:
দক্ষ অভিজ্ঞ প্রশাসন ছাড়া কোন পেশা, দপ্তর, মন্ত্রণালয় কাঙ্খিত উন্নতি করতে পারে না। জাতির উন্নতির সোপান শিক্ষা। আর প্রাথমিক শিক্ষা হলো মূল ভিত্তি। তৃণমূল মানুষের সন্তানদের মধ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে না পারলে দেশের চাহিদা অনুযায়ী উন্নতি ব্যাহত হবে। তাই প্রয়োজন প্রশাসনের তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পরেও গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির দায়িত্বে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা আছে। কেবল নাই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ক্যাডার সার্ভিসের অভাবে বিভিন্ন দপ্তরের লোক ক্ষণিক সময়ের জন্য প্রাথমিকে থেকে অভিজ্ঞতাবিহীন অবস্থায় তাদের ধারণা মোতাবেক কিছু কাজ করে চলে যায়। এ আসা-যাওয়াকারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকা প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশার অন্যতম কারণ। আজকের দিনে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের একমাত্র প্রত্যাশা থাকা প্রয়োজন প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক ছাড়া সকল নিয়োগ বন্ধ করে সর্বস্তরে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে দক্ষ অভিজ্ঞ প্রশাসন তৈরি করা। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার শ্লোগান বা বক্তব্য দিয়ে গলার স¦র বিঘিœত না করে প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির প্রতি মনোযোগী হই। এতে প্রাথমিক শিক্ষায় তরুণ মেধাবীরা দলে দলে যোগদান করবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষায় দেশ এগিয়ে যাবে।
২. শিক্ষক সংকট:
শিক্ষক সংকট প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে গাড়ির পেট্রোল পাত্রের গায়ে লেখা ‘জম্ম থেকে জ্বলছি’র কথা মনে হলো। স্বাধীনতার পরও অদ্যাবধি শিক্ষক সংকট জম্ম থেকে চলে আসছে। নয় বছর ধরে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি বন্ধ। সহকারি শিক্ষক পদেও শিক্ষক সংকটে পাঠদানের বেহাল দশা। শিক্ষক সংকটে বিঘিœত হচ্ছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। মানহীন হয়ে প্রাণহীন হতে চলেছে শিক্ষা। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা নিয়ে প্রশ্নকে বড় করে দেখা হয় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সংকট দূর না করে একতরফাভাবে দায়ী করার মতো বাস্তবতা বর্জিত বিষয়টি নিয়ে সকলের ভাবা উচিত।
৩. শিক্ষায় অপর্যাপ্ত বাজেট:
স্বাধীনতার পর থেকে বাজেটের আকার বেড়েই চলছে। পদ্মা সেতুসহ নান ধরণের বৃহৎ প্রকল্পের কাজ করে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষায় বাজেট লজ্জাজনক। শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমেই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার স্থবিরতা কাটতে পারে। শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশাও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব বাজেটের কৃপণতার কারণে কার্যকর হয় না।
৪. শিক্ষকের বহুমুখী কাজ:
পদোন্নতি, শিক্ষক সংকট, চাহিদা অনুযায়ী বেতন স্কেলসহ অহেতুক নানা নিপীড়ণ থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান থেকে বিরত রাখার মানসিকতা দূরে ঠেলে দিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রাখেন। প্রাথমিক শিক্ষকেরা এদিক থেকে বড় ভাগ্যবান উচ্চ বিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষক বা পেমাজীবীরা সৃষ্টিকর্তার এ নির্দয় করুণা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান কর্মে কাজগুলো হলো: বছরে ৩টি পরীক্ষা নিয়ে সাথে সাথে খাতা মূল্যায়ন, ফলাফল বই ও প্রগতিপত্র হালফিল করে অভিভাবকদের কাছে প্রেরণ, ছুটির সময় হোম ভিজিট, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি হিসাব সংরক্ষণ, বিস্কুট খাওয়ানো, হিসাব রাখা, শিক্ষকের উপস্থিতির স্বাক্ষর সম্বলিত প্রতি মাসে মাসকাবারার তথ্য প্রেরণ, প্রতি মাসে উপস্থিতি অনুপস্থিতির তথ্য হালফিল করা, দৈনন্দিন পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, উপকরণ তৈরি ও সংগ্রহ করা, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, অভিভাবক সমাবেশ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার আয়োজন, বই বিতরণ, মাস্টার রোল, বহু ফাইল ও রেকর্ড হালফিল রাখা।
৫. শিক্ষাদান বহির্ভূত কাজ:
প্রায় সারা বছরই প্রাথমিক সমাপনীর কাজে শিক্ষকদের অফিসে ব্যস্ত রাখে। ঢাকা শহরে বিশেষ করে বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু ফুটবল খেলার দর্শক সারিতে শিক্ষার্থীসহ ৪/৫ দিন অবস্থান করতে হয়। গ্রাাম অঞ্চলে ও জন প্রতিনিধিদের বা বিশেষ উৎসবে শিক্ষকেরা দর্শকের চেয়ার অলংকৃত করে থাকেন। ভোটার তালিকাসহ সকল পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নানাপ্রকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজ শিক্ষকদের দিয়ে করানো হয়। প্রতিবছরই শিশু জরিপ কাজটি প্রাথমিক শিক্ষকদের করতে হয়।
৬. শিক্ষকদের অফিসমুখী করে রাখা:
শিক্ষকদের যাবতীয় প্রাপ্য আবেদন করেও তদবির বা ঘুষ ছাড়া অধিকাংশ স্থানে প্রাপ্তির অনিয়ম যেন আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ অনিয়মের জন্য নেই কোন জবাবদিহি বা শাস্তি। বরং এটাই নিয়মে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা আজ যেন শিক্ষকেরা হারিয়ে ফেলছে, এমনকি শিক্ষক নেতৃবৃন্দও যেন প্রতিবাদের পরিবর্তে জী স্যার বলতে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রশাসনকে জম বা আজরাইলের মতো আতঙ্ক মনে করে।
৭. শিক্ষকদের বড় ধরনের কাজ:
বদলি, প্রমোশন বেতন বৈষম্য দূরীকরণসহ জাতীয় পর্যায়ে প্রায় সব কাজই মন্ত্রণালয় করে থাকে। ঢাকা শহরের শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ পোষ্যদের কোটায় শিক্ষকতার অধিকারহরণসহ ব্যাপকভাবে নোট, গাইড, কোর্চি সেন্টারের প্রসার চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। আরো
সফলতা অর্জন করেছে প্রাথমিক ছুটির তালিকায় গিট্টু লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ করে।
প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান সরকারের বিনমূল্যে বই বিতরণসহ অসংখ্য অর্জন আজ ম্লান হয়ে যাচ্ছে, মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতায় অভাবে। আসুন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এদেশের তৃণমূল মানুষদের সন্তানদের মানসম্মত শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক, মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা একযোগে চ্যালেঞ্জগুলো দূর করি। চ্যালেঞ্জগুলো দূর করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সকলের কাছে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা