একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ তার শিক্ষিত জনশক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষিত জনশক্তি সরবরাহও অভূতপূর্ব। স্বাধীনতার পরে বহুগুণে বেড়েছে শিক্ষিত জনশক্তি। বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। তবে শিক্ষিত জনশক্তি পায়নি কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা বা মানসম্পন্ন শিক্ষা। চাকরির বাজারে রয়েছে দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে অতীত-বর্তমানের বেশ কিছু তফাত দেখতে পাই। শিক্ষার গুণগত দিকটি তো আছেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, দক্ষতা, মানবিক গুণাবলি অর্জনসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক থেকে পিছিয়ে আছে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা আর অর্থলিপ্সাই যেন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য আর আমাদের করণীয় সম্পর্কে না জানা।
একজন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ভর্তিযুদ্ধে জয়লাভকে তার যোগ্যতা হিসেবে জানে। আবার পাস করে ভালো চাকরি আর প্রচুর টাকা উপার্জনকেও জানে তার লক্ষ্য হিসেবে। জনগণের করের টাকা খরচ করে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগটাকে একান্তই নিজের মনে করে অনেকে। অনেক সময় দেশের প্রতি করণীয় কিছু থাকতে পারে তাও ভুলে যায়। এসবের কারণ বিবেকবোধ জাগ্রত করার মতো নয় শিক্ষাব্যবস্থা। আর বিবেকবোধ এমন একটি বিষয় যা প্রতিনিয়তই চর্চা করা দরকার।
মানসম্পন্ন শিক্ষার একটা বিশেষ দিক হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক। বর্তমানে বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে বাড়ছে শিক্ষার্থী সংখ্যাও। সবাই চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। দেশ ব্যর্থ হচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষার সুযোগ দিতে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাড়ছে সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছড়াছড়ি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহও বাড়ছে সমান তালে। অন্যদিকে ভর্তিযুদ্ধে বিজয়ী শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে পিছিয়ে। গড়ে উঠছে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত সুসম্পর্ক। মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তো হচ্ছেই, তারপরও রয়েছে সেশনজটের বাড়তি চাপ। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগের বিতর্কটা থেকেই যাচ্ছে। অনেকের যোগ্যতার মধ্যে থাকে রাজনীতি বা দলের ক্ষমতা। অনেক সময় বিকল্প সুযোগ থাকতেও পাঠদানে অক্ষম মেধাবীরা হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যেখানে তিনি তাঁর মেধাকে অন্যত্র ব্যবহার করলে পেতেন অধিক সফলতা। অনেকের মতে শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে না। একে তো পিএইচডি ছাড়া নিয়োগ, অন্যদিকে ছাত্রজীবন শেষ করেই একজন শিক্ষার্থী হয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক; মাঝখানে থাকে না কোনো প্রশিক্ষণ। যার ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের মানের তফাত তো থাকেই, থাকে অনেক অপূর্ণতাও।
সমস্যার ছোট-বড় বহু কারণ দেখানো সম্ভব। তবে সমাধানের জন্য আমাদের চেষ্টা থাকাটাও জরুরি। কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে সরকারের পদক্ষেপ সাধুবাদ পাওয়ার মতো। তবে দেশে কারিগরি শিক্ষা আর স্বনির্ভরতার জন্য শিক্ষা জনপ্রিয় হলেই একটা বড় সমাধান আসবে। এর আগে বাড়াতে হবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান। বর্তমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নানা কারণে ব্যর্থ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত শিক্ষার্থী তৈরিতে। বিভিন্ন কৌশলে ছাত্ররাজনীতির ভয়াবহতা কমিয়ে আনাও আবশ্যক।
এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংখ্যার দিক দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলেও গুণগত দিক দিয়ে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ২০১৫ সালে শুরু হলো এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। যার চতুর্থ লক্ষ্যই হলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। সুতরাং উন্নয়নের প্রকৃত সাফল্য শিক্ষার মানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তিই পারবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্নীতির মতো বড় বড় সমস্যার সমাধান করতে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়