শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়, তাহা হইলে ইহার প্রধান ভিত্তি হইল প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে সরকার উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করিয়াছে আরো আগেই। এইবার সেই উদ্যোগের মুকুটে আরো একটি পালক যুক্ত হইতে যাইতেছে। জানা গিয়াছে, আগামী পহেলা মার্চ হইতে সরকার দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত শিশুদের এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মাকে উপবৃত্তি প্রদান করিবার উদ্যোগ নিয়াছে। উপবৃত্তির অন্যান্য প্রকল্পের মতো ইহারও উদ্দেশ্য হইল বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির হার বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপন করা, দারিদ্র্যের হার হ্রাসকরণ, শিশুশ্রম বন্ধকরণ, শিক্ষার্থীদের ঝরিয়া পড়া রোধকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারকরণ এবং সর্বোপরি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। বিশেষ করিয়া বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের পরিবারের শিশুদের মায়েদের জন্য এই উপবৃত্তি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। কারণ চরম দারিদ্র্যের কারণে বাধ্য হইয়া এই ধরনের ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়াও পিতামাতার কাজে সহায়তা করে, রিকশা-ভ্যান চালায়, বাস-টেম্পুতে হেলপারের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত থাকে। উপবৃত্তি পাইবার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রতি মাসে বিদ্যালয়ের মোট কর্মদিবসের ৮৫ শতাংশ উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা রহিয়াছে। সুতরাং নূতন চালু হওয়া মায়েদের জন্য উপবৃত্তি তাহার শিশুর স্কুলে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করিবে নিঃসন্দেহে। তবে এই ক্ষেত্রে লক্ষ রাখিতে হইবে, উপবৃত্তি লইয়া অতীতে যেসব অনিয়ম হইয়াছে তাহার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন স্কুল আছে। শহরের স্কুলের শিক্ষার্থীদের অবস্থা কমবেশি ভালো। এখন প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কয়েক যুগ পূর্বেও এদেশে বিদ্যালয়ে ভয়াবহ অবকাঠামোগত সমস্যা ছিল, শিক্ষকদের সমস্যা ছিল প্রকট। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন, তখন হইতেই মূলত উন্নয়নের এই ধারা শুরু হয়। ২০১৩ সালেও বর্তমান সরকার ২৬ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা তুলনামূলকভাবে কম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ধরিয়া রাখিবার জন্য চলিতেছে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক সংস্কারকাজ। শ্রেণিকক্ষসহ অন্যান্য পরিবেশ ভালো করিবারও উদ্যোগ লইয়াছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হইতেছে কোটি কোটি টাকা। এইখাতে বাজেট বরাদ্দ আছে, ন্যূনতম মানসম্পন্ন অবকাঠামো আছে, তবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার কিছুটা ঘাটতি থাকিয়াই যাইতেছে।
মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। স্কুলের অবকাঠামো ও উপবৃত্তির নূতন নূতন খাত চালু করিয়া শিক্ষার্থীদের ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা তখনই সার্থক হইবে যখন মানসম্পন্ন শিক্ষার আলো ছড়াইয়া পড়িবে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাঝে।
সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক