যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংস্কার না করলে সব কিছুই তার উপযোগিতা হারায়। স্বাস্থ্য খাত এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর পেছনে শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে মৌলিক সংস্কারের অভাবকেই দায়ী করেন। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ত সংস্কার চলছে এবং আরো গতিশীল ও কার্যকর করা হচ্ছে। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত সামগ্রিকভাবে এখনো পুরনো ধারায়ই চলছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরো পিছিয়ে যাচ্ছে।
যেকোনো দেশেই চিকিৎসাশিক্ষা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। প্রতিটি দেশই চায় তার দেশের মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীটি শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত থাকুক। মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক ছাড়া যোগ্য চিকিৎসক তৈরি একটি অকল্পনীয় বিষয়। আমাদের দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট একটি সর্বজনস্বীকৃত সমস্যা। তার ওপর একের পর এক মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা আসছে।
বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে বর্তমান সরকার ব্যাপকসংখ্যক চিকিৎসককে শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর মধ্যেও ফাঁক রয়ে গেছে। শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির প্রধান শর্ত হচ্ছে ওই বিষয়ে প্রার্থীর স্নাতকোত্তর (Postgraduation)) ডিগ্রি থাকতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন সব চিকিৎসকের জীবনের একটি আকাঙ্ক্ষা। এই ডিগ্রি অর্জনের পরীক্ষা অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। একজন চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরই ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং সে সময় থেকেই বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা শুরু হয়। এখানে বয়স বা সিনিয়রিটির বিষয়টি বিবেচনায় না নেওয়াই সমীচীন। যিনি যোগ্য ও মেধাবী তিনিই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন এবং বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। অথচ দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বয়স বা সিনিয়রিটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। একজন মেধাবী চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন ও পদোন্নতির সব মাপকাঠি পূরণের পরও শুধু সার্ভিসে জুনিয়র বলে বসে থাকতে হয়। অথচ তাঁর পাঁচ-সাত বছর পর ১০-১২ বার পরীক্ষা দিয়ে কেউ পাস করার সঙ্গে সঙ্গে শুধু সার্ভিসে সিনিয়র হওয়ার কারণে যোগ্য ও অভিজ্ঞ বলে বিবেচিত হন।
অথচ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ওই জুনিয়র চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা ওই সিনিয়রের চেয়ে পাঁচ-সাত বছর বেশি। স্নাতকোত্তর পাসের পরই শুধু কেউ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, তার আগে নয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পদোন্নতিতে সিনিয়রিটি একটি মুখ্য বিষয়। কিন্তু এটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন, স্বাস্থ্য ক্যাডার একটি বিশেষায়িত (Technical) ক্যাডার। এটা অন্যান্য সাধারণ ক্যাডারের মতো নয়। বিশেষজ্ঞ হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সার্ভিসে যোগদানের তারিখের চেয়ে (date of joining) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের তারিখকে (date of postgraduation) মুখ্য বিবেচনা করাই যৌক্তিক। বছরের পর বছর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকতা করে শুধু সার্ভিসে জুনিয়র হওয়ার কারণে পদোন্নতিবঞ্চিত ও বিলম্বিত হওয়া যেকোনো মেধাবী ও যোগ্য চিকিৎসকের ক্ষেত্রে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। অন্যদিকে বারবার পরীক্ষা দিয়ে, বছরের পর বছর স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী থেকে হঠাৎ একদিন পাস করেই পরদিন তিনি পদোন্নতি তালিকায় শীর্ষ ও যোগ্যতম হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাত এভাবে বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ হারাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে তো বটেই; আমাদের পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতেও শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি ক্ষেত্রে Year of postgraduation-কে মুখ্য যোগ্যতা বলে ধরা হয়। চাকরিতে অভিজ্ঞতার চেয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অভিজ্ঞতাকে শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাওয়ার মূল মানদণ্ড ধরা হয়। বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাঁর অভিজ্ঞতার বয়স বেশি, তিনি তো বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে আগে পদোন্নতি পাবেন—এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির নীতিমালায় আশু সংস্কার প্রয়োজন।
এ সংস্কার না আনতে পারলে বাংলাদেশের চিকিৎসাশিক্ষায় মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের আকাল দেখা দেবে। বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রির প্রাচুর্য দেখা যায়। ডিপ্লোমা, এমএসসি, এমফিল থেকে শুরু করে এফসিপিএস বা এমডি/এমএসের মতো সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর চিকিৎসা ডিগ্রি রয়েছে। বেসিক সাবজেক্টের বেশ কিছু বিষয়ে এখনো এমফিল সর্বোচ্চ স্বীকৃত ডিগ্রি এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে তা বিবেচিত হওয়া যৌক্তিক। এমফিল ডিগ্রি সম্পন্ন করতে শিক্ষার্থীকে থিসিস সম্পন্ন করার প্রয়োজন হয়, যা ওই বিষয়ে শিক্ষক হওয়ার একটি অন্যতম শর্ত। যেকোনো স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে গবেষণা (থিসিস/ডিজারটেশন) শেখার সুযোগ না থাকলে সেই ডিগ্রি কখনোই ওই বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচিত হতে পারে না। এটি অত্যন্ত মৌলিক একটি ধারণা এবং পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল কোনো দেশের চিকিৎসাশিক্ষায়ই এর ব্যত্যয় ঘটে না। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। একসময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব থাকায় বাংলাদেশে দ্রুত বিশেষজ্ঞ তৈরির তাগিদ থেকে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ডিপ্লোমা বা এমসিপিএস ডিগ্রি চালু করা হয়। প্রথমে তা এক বছর মেয়াদি ছিল, যা পরবর্তী সময়ে দুই বছর মেয়াদি করা হয়।
ডিপ্লোমা কোর্সের কারিকুলামের থিসিস বা ডিজারটেশন করার বিষয়টি নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ডিগ্রি চালু আছে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য, শিক্ষক তৈরির জন্য নয়। ডিপ্লোমা বা এমসিপিএস ডিগ্রিধারীরা অবশ্যই কনসালট্যান্ট বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু কখনোই শিক্ষক হিসেবে নয়। এটি মেডিক্যাল শিক্ষার মৌলিক নীতির বিরোধী। কেননা কোর্সটির কারিকুলাম তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য, শিক্ষক তৈরির জন্য নয়। ভবিষ্যতে যেকোনো পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রিগুলোকে বাদ দিয়ে ডিপ্লোমা বা এমসিপিএসকে বিবেচনায় আনলে দক্ষ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ তৈরির স্বপ্ন দুরাশাই থেকে যাবে।
স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার কোনো সহজ বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ধারাটির হঠাৎ আমূল পরিবর্তন অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু ধাপে ধাপে সংস্কার আবশ্যক। বর্তমান বিএমএর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ওপরে উল্লিখিত সংস্কার আনতে নীতিনির্ধারকদের পথ প্রদর্শন করবে বলে আমি আশাবাদী। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের উদ্বোধন করতে গিয়ে ‘মানুষ মারার ডাক্তার বানাবেন না’ বলে স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আদর্শ ও যোগ্য চিকিৎসক তৈরির কারিগর হলেন যোগ্য শিক্ষকরা। শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে আশু সংস্কার না আনতে পারলে যোগ্য চিকিৎসক তৈরিতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান অধরাই থেকে যাবে। দেশের আপামর জনসাধারণকে আসছে দিনে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক