উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল হচ্ছে উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশের গেটওয়ে। যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি তাদের নিকট প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। প্রতি বছর যদিও কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষা হয় তারপরেও প্রতিটি পরীক্ষাই বেশ কিছু নতুন মেসেজ নিয়ে হাজির হয়। যে গুলো আমাদের চিন্তার যথেষ্ট খোরাক যোগায়।
এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলের দিকে তাকালে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় দেখতে পাই। যেমন যশোর বোর্ডের চমক। যশোর বোর্ডের চমক আসলেই আমাদের চমকে দিয়েছে। গত বছর এই বোর্ড ছিল সর্বনিম্ন, এবার সবার উপরে। যশোর বোর্ডে ২০১২ সালে পাশের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০১৪ সালে ছিল ৬০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ২০১৫ তা ছিল ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এই ফল গতবার গোটা এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কেন এমনটি হয়েছিল? প্রতি বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞগন ও সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ৩২ সেট প্রশ্ন করা হবে। তাদের মধ্যে থেকে লটারীর মাধ্যমে একটি সেট বাছাই করে পরীক্ষা গ্রহন করা হবে। যশোর বোর্ড সেই উপযুক্ত কাজটিই করেছিল। কিন্তু তার ফল হয়েছিল উল্টে। অর্থাৎ পাশের হারে নেমেছিল ধ্বস। ফলে
র্তৃপক্ষসহ অন্যান্য বোর্ড নিশ্চয়ই যশোর বোর্ডের ওপর নাখোশ হয়। হওয়ারই কথা! কিন্তু আমরা কেউ চিন্তা করছি না বা বলছি না যে, ওটিই ছিল আসল ফল, ঐটিই ছিল আসল মূল্যায়ণ। যশোর বোর্ড চাপে থাকার কারণে এবার যথাযথ (?) ব্যবস্থা গ্রহণ করে ফলে চমক লাগিয়ে দিয়েছে। এবার তাই পাশের হার ৮৩ দশমিক ৪২ শতাংশ যা সকল সাধারন শিক্ষাবোর্ডের ওপরে। বোর্ডের ফল ভাল হলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ার নজির আছে। কিন্তু একেবারে দ্বিগুণ হওয়া তো এক ধরনের জাদু। সেই জুাদুটিই যশোর বোর্ড এবার প্রদর্শণ করেছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে অযথা আনন্দিত না হয়ে।
গত বছর সকল বোর্ড মিলে ইংরেজিতে ফেল করেছিল ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর যশোর বোর্ডে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করেছিল। এবার যশোর বোর্ডে ইংরেজিতে পাশের হার ৮৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এখানেও যশোর বোর্ড চমক দিয়েছে। অর্থাৎ যশোর বোর্ডের ডাবল চমক। ইংরেজিতে ঢাকা বোর্ডে এবার পাশের হার ৮৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৮৪ দশমিক ০৪ শতাংশ, কুমিল্লায় ৮৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, চট্টগ্রাম ৮৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, সিলেট ৭৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, দিনাজপুর ৭৮ দশমিক ২৬ শতাংশ, কারিগরি ৯৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আট বোর্ডে ৮৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এখন ইংরেজিতে পাশ কিংবা এ প্লাস পাওয়া কোন বিষয় নয়। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই টাচ করুক আর নাই করুক, বিষয় জানুক আর নাই জানুক, ইংরেজি লিখতে, বলতে, শুনতে, বুঝতে পারুক আর নাই পারুক পাশ করতে ও এ প্লাস পেতে কোন বাধাঁ নেই। এটিও আর একটি বিষয় যেটির ওপর আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু কবে দিব?
এবার পজিটিভ কয়েকটি বিষয় ঘটেছে যেগুলো উল্লেখ করার মতো । ২০১৫ সালে ১২টি বিষয়ে ২৩টি পত্রে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছিল। এবার ১৯টি বিষয়ে ৩৬টি পত্রে পরীক্ষা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নের আওতা বাড়ায় নম্বর বেশি উঠেছে এবং শিক্ষার্থীদের ভীতি কেটেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে। ৮৪৮শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছে, গতবার এই সংখ্যা ছিল ১৩৩। ২৫টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাশ করতে পারেনি যে সংখ্যা গতবার ছিল ৩৫। দিক দুটো উল্লেখ করার মতো। গত বছরের তুলনায় এবার পাশের হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি আর এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৮২জন। মোট এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবার ৫৮ হাজার ২৭৬জন। তাছাড়া প্রথমবারের মতো এবার বাংলা ও ইংরেজিতে দুই পত্র করে চারপত্রে পরীক্ষা দিয়েছে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ১৯৮৬ সালে আলিম স্তর এইচ এসসির মান অর্জনের পর থেকে ইংরেজি ও বাংলায় এক পেপার করে পরীক্ষা দিতে হতো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের।
ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয়ে ভর্তি থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বৈষম্য দুরীকরণের জন্য এবার তাদের পরীক্ষা চার পেপারে নেওয়া হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় দিক। সবকিছুর ওপর যেটির কথা বলতে হয়, সেটি হচেছ প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের ঘটনার কথা এবার শোনা যায়নি। গতবছর পরীক্ষার আগের দিন রাতে সাজেশন আকারে এবং পরীক্ষার দিন সকালেও নৈব্যক্তিক প্রশ্ন বাইরে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল।শিক্ষা মন্ত্রীর যথাযথ পদক্ষেপের ফলে বিষয়টির অনেক উন্নতি হয়েছে।
গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষার্থীরা মোট নম্বর জানতে পারত না। এবার জিপিএ-র পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক নম্বর দেয়া হবে। তারা অনলাইনে সৃজনশীল, নৈর্ব্যক্তিক এবং ব্যবহারিকের নম্বর আলাদা জানতে পারবে। এটিও একটি উল্লেখযোগ্য দিক কারন একজন শিক্ষার্থী সকল বিষয়ে ৮০ থেকে ৮১ কিংবা ৮২ নম্বর পেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অন্য একজন শিক্ষার্থী পেয়েছে ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ নম্বর। গ্রেডিংএ এদুজন শিক্ষার্থীকেই একই মানদন্ডে মাপা হয় যা কোনভাবেই ঠিক নয়। একজন শিক্ষার্থী তত্বীয় পরীক্ষায় ৭৫ এর মধ্যে পেয়েছে ২৪ আর ব্যবহারিক পরীক্ষায় পেয়েছে ২৫ এর মধ্যে ২৪। এই বিষয়টিও প্রদর্শিত হবে। তাই বিভিন্ন মহলের দাবি অনুযায়ী বোর্ড এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার গ্রেডিং-এর ধোঁয়াশা কিছুট হলেও কাটবে।
ক্রমেই বাড়তে থাকা মাদ্রাসা ও কারিগড়ি বোর্ডের ফলাফল এবার নি¤œগামী। এটিও ভাল দিক। কারন মাদ্রাসা শিক্ষা এমনিতেই অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু পাশের হারের ক্ষেত্রে প্রতিবছরই দেখা যায় তারা এগিয়ে যা সঠিক চিত্র প্রদর্শন করেনা। কারিগড়ি শিক্ষা এখনও শক্ত ভীতের ওপর দাড়াঁতে পারেনি অথচ পাবলিক পরীক্ষার ফলে তারা প্রতি বছরই এগিয়ে থাকে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই দৃষ্টিতে এসেছে।তাই হয়তো বিষয়টি এবার একটু আলাদা হয়েছে।
উচচশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে হয় ভর্তিচছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের। দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন শর্ত ও নিয়ম রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের বিপাকে পড়তে হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা। তারিখ নির্ধারণে সমন্বয়হীনতা, কয়েকিট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহন, প্রতিটি পরীক্ষার জন্য আলাদা ফি নির্ধারন, একই ইউনিটে ভর্তিতে একাধিক শিফটে পরীক্ষা গ্রহণ, মাধ্যমিক ও উচচ মাধ্যমিকের সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন সংযোজন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে এক ডজনেরও বেশি আবেদন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের অর্থিক ক্ষতি ও মানসিক চাপে ভুগতে হয়। বিভিন্ন শিফটের পরীক্ষার মধ্যে , প্রশ্নপত্রের মধ্যে সমন্বয় নেই, কোন শিফটের পরীক্ষা সহজ, কোনটি কঠিন, কোনটি পরিচিত কোনটি অপরিচিত বিষয় থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। এ বিষয়গুলো আমরা যখন আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখনও ছিল। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা আলোচনা হয়েছে কিন্তু সমাধান হয়নি। জাফর ইকবাল স্যার জাতীয় পর্যায়ে দুএকবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বিষয়টি সমাধানের জন্য কিন্তুু খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি অর্থাৎ উচচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের এবারও বিপাকে পড়তে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি বিষয়গুলোর একটি সহজ সমাধান বের করতে পারে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে। ইউজিসি বলছে দুটি নির্মানাধীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৯, তবে এখনও ৩৭টিই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদের মধ্যে দুটি-একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অন্যটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া প্রথমবর্ষে আসন সংখ্যা ৪০ হাজার ৭২৭। ৫৮হাজার ২৭৬ জন এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ১৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেনা। এখানে সব এ প্লাস ধারী শিক্ষার্থীরাই যে ভর্তি হবে তাতো নয়, শুধু ’এ’ পাওয়া শিক্ষার্থারও তো ভর্তি হবে। তার মানে এ প্লাস পেয়েও ভর্তির টেনশন কাটল না।
কৃতকার্য ও অকৃতকার্য সকল শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচিছ । যারা এ প্লাস পাওনি এমনকি যারা অকৃতকার্য হয়েছ তাদেরকে বলছি তাদের চিন্তার কিছু নেই, দু:খ পাওয়ার কিছু নেই। আপাতত হয়তো একটু খারাপ লাগবে তাতে একেবারে ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই।তোমরা নিশ্চয়ই জনপ্রিয় কথাশিল্পী অনিসুল হকের লেখাটি পড়েছে। তিনি যথার্থই বলেছেন, তুমি যদি মেডিকেল কলেজে চান্স না পাও তাহলে তুমি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মালিক হবে, তুমি যদি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পার তাহলে তুমি বিরাট বিরাট শিল্প কারখানার মালিক হবে যেখানে অনেক ইঞ্জিনিয়ার তুমি নিজেই নিয়োগ দিবে। তুমি যদি পরীক্ষায় ফেল কর তাহলে মন্ত্রী হবে আর যদি ভালভাবে পাশ কর তাহলে টিচার হবে যা মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেকেই চায়না। তোমরা যারা সাইফুর রহমানের উপন্যাস ’শুধু একটি প্লটের জন্য’ পড়েছ তারা নিশ্চয়ই দেখেছ যে, যে শিক্ষার্থী ক্লাসে ভাল ছিল সে হয়েছে গ্রামের এক কলেজের শিক্ষক আর যে শিক্ষার্থী সবচেয়ে পেছনের সারিতে ছিল সে হয়েছে মন্ত্রী। কাজেই তোমাদের ভয় নেই। মেধা আলাদা জিনিস। মেধার প্রকাশ সবসময় পাবলিক পরীক্ষার ফল দ্বারা বিচার করা যায়না। সাফল্য তোমাদের আসবেই কোন না কোন ভাবে।
লেখক: প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক, বর্তমানে ব্রাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।