ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার ভোরে রমনা এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুপুরে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম আহমেদ এ রিমান্ড আবেদন জানান। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুল্লাহ আল সায়েম কলাবাগান থানায় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধন ২০০৩) এর ১০ ধারায় একটি মামলা করেন। ওই মামলাতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আরো বলেন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় আহসানউল্লাহ ক্যাম্পাস হলেও কলাবাগান থানাধীন পান্থপথ এলাকায় ওই শিক্ষকের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তবে তিনি সাধারণত রমনা থানা এলাকার বাসায় থাকতেন। তড়িৎ কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস সহকারী প্রক্টরের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে নিজের বিভাগের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত শনিবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই শিক্ষকের শাস্তি দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির তেজগাঁও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
তড়িৎ কৌশল বিভাগের ছাত্র মোহাইমিনুল সে সময় বলেন, উনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এর আগেও কয়েকবার তিনি একই কাজ করেছেন।
সর্বশেষ এ সংক্রান্ত একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করেছিলাম। এরপর তিনি ওই ছাত্রীকে চাপ নিয়ে মিথ্যা বিবৃতি লিখিয়ে নেন। আমাদের দাবি, অবিলম্বে এই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে হবে এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরে বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করে উপাচার্য অধ্যাপক এ এম এম শফিক উল্লাহ শিক্ষক ফেরদৌসকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্তের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা শান্ত হন।
উপাচার্য সেদিন বলেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির দুটি ‘বেনামী অভিযোগ’ পাওয়া গেছে। তাছাড়া একজন ছাত্রীর কাছ থেকে নির্দোষিতার পক্ষে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টার একটি ভিডিও কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার পেছনে আর কেউ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
ইনবক্সে যৌনবার্তা, পর্নোও পাঠাতেন মাহফুজ: পান্থপথের ফ্ল্যাট ছিল শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঠিকানা। শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া এ ফ্ল্যাটে ছলে-বলে-কৌশলে শিক্ষার্থীদের ঘৃণিত এ কাজে বাধ্য করে আসছিলেন মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস। তার বিরুদ্ধে বেশ কছর ধরে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করে আসছিলেন নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকের দাপটে সব মিলিয়ে যাচ্ছিল। নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের বেদনা অব্যক্তই থেকে যায়। তবে শেষ রক্ষা হল না দাপুটে শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌসের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার নিয়ে হলি ফ্যামিল রেড ক্রিসেন্ট এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত মাহফুজ। আরেকটি ফ্ল্যাট রাজধানীর পান্থপথ আবাসিক এলাকায়। প্যরাডাইস সুইটসের পাশে শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ওই ফ্ল্যাটে শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাকমেইল করে এনে জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করে আসছিলেন।
মাহফুজের ব্ল্যাকমেইল করার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়া বোঝানোর নামে শিক্ষার্থীদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন। দ্বিমত করলে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হত। ফলাফল সেমিস্টার ড্রপ আউট। প্রাথমিক এ প্রস্তাবে শিক্ষার্থী সায় না দিলে অর্থাৎ পান্থপথের ফ্ল্যাটে যেতে অস্বীকৃতি জানালে বশে আনতে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস। চেষ্টা করতেন শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ম্যানেজ করতে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাসায় ফোন দিয়ে বলতেন, আপনার মেয়ে তো পড়াশোনা কিছু পারে না। পরীক্ষায় পাশও করতে পারবে না। খাখামা টাকা-পয়সা নষ্ট করছেন। দেখি ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
স্বাভাবিকভাবেই এ কথা শুনে শিক্ষকের সহযোহিতা চাইতেন অভিভাবক। তখন তিনি (শিক্ষক) বলতেন, ক্লাসের পরে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বলবেন। আমি পড়া বুঝিয়ে দেব। পরিবারগুলোকে এমনভাবে ম্যানেজ করতেন যেন শিক্ষার্থী ওই ফ্ল্যাটে যেতে না চাইলেও তাকে জোর করে পাঠানো হয়। এভাবে পরিবারকে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীকে তার পরিবার থেকে আলাদা করতেন। শিক্ষার্থীরা পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হননি যে, মাহফুজুর রশিদ শিক্ষক নন, তিনি লম্পট।
ব্ল্যাকমেইলের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা আরো জানান, ফ্ল্যাটে ডেকে কৌশলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে তিনি (শিক্ষক) তার অফিসিয়াল নম্বরে আজেবাজে ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখতেন, যা দিয়ে পরবর্তীতে তাদের ফাঁদে ফেলতেন। এসব কৌশল অবলম্বন করে মাহফুজুর রশিদ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করতেন পান্থপথের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে। সেখানে নিয়ে যৌন নিপিড়ন এবং শারীরিক নির্যাতন করতেন। এ কৌশলে অসংখ্য ছাত্রীর সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছেন লম্পট ওই শিক্ষক। যার স্বাক্ষী পান্থপথের সেই ফ্ল্যাট।
কথা না শুনলে ভার্সিটিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানোর হুমকিও দেয়া হতো। তাদের দেয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে বহুবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। জোরপূর্বক অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য করা এবং নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নেয়ার জন্য চাপ দিতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
পরিবারকে হারিয়েছেন আগেই, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়কে, সেমিস্টার ড্রপের ভয়াবহতা, শিক্ষার্থীদের মোবাইল থেকে তার মোবাইলে পাঠিয়ে রাখা আজেবাজে ম্যাসেজ, ভার্সিটিতে সহপাঠীদের কাছে নিজের সম্মান হারানোর ভয়— এসব কারণে মাহবুব রশিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাননি ভুক্তভোগীরা। দিশেহারা হয়ে অনেকে সুইসাইডের চেষ্টা করেছেন বলেও জানিয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের মোবাইলে নিজের ন্যুড পিক পাঠানো ছিল ওই শিক্ষকের কাছে অতি সহজ একটা ব্যাপার। আজেবাজে টেক্সটিং, যা হরহামেশাই পাঠানো হত।
অবশেষে সব ভয়, লজ্জা ভেঙে সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন ভুক্তভোগীরা। সবাই একসঙ্গে গত শনিবার থামিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম। শুরু হয় আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনের তোপে মুখ খুলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসের চৌহদ্দিতে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় মাহফুজকে। অভিযোগ পাঠানো হয়, হাইকোর্ট কর্তৃক যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে গঠিত কমিটিতে।