আগে মূল লেখাটা লিখতে হয় তারপর শিরোনাম দিতে হয়। কিন্তু আমার খাসলতটা ভিন্ন। যুতসই শিরোনাম না লিখে মূল লেখাটা শুরু করতে পারি না। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
শোক সংবাদ লিখিনি অনেকদিন হলো। নেতার দেহত্যাগে কিছু লেখা কঠিন বটে। অপরিচিত মানুষের প্রয়াণে শোক সংবাদ লেখা খানিকটা সহজ হয়তো। বাংলায় শোক সংবাদ লিখতে অনেক বিশেষণ ব্যবহার করতে হয়ে। আমি সেসব জানিনে। তাই সাদামাটা শব্দেই লিখতে হচ্ছে বিশ্ববিস্তৃত এই অতিকায় জটাধারী বিপ্লবী বটবৃক্ষের শোকসংবাদ।
আইকনিক লিডার ফিদেলকে আমি কখনো দেখিনি। ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখেছিলাম প্রায় দেড়যুগ আগে। সে প্রসঙ্গ অনেকদিন পরে লিখবো। কিউবায় যেতে পারিনি।
তবে, ফিদেল হিমালয় না দেখলেও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন, সেই খবর তাঁর জবানির বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় জানতে পেরেছি। আমি ছোট মানুষ। হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকেও দেখিনি, ফিদেলকেও না।
প্রিয় পাঠক, এবার আমার লেখাটা শুরু করছি।
শিক্ষা ভবনের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেয়ালে কোনো এক ফিদেল ও বঙ্গবন্ধুভক্ত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেলের সেই অমৃতবাণী ইংরেজিতে লিখে ছবিসমতে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই ভবনে দেয়াল লিখন নিষিদ্ধ। তাই নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে ওই দেয়ালে কারো ছবি বা কোনো শিক্ষা ব্যবসায়ীর স্টিকার লাগানো দেখলে মনে মনে গালি দিতাম। কিন্তু যেদিন দেখলাম ফিদেলের ছবি, সেদিন অন্যরকম অনুভূতি হলো। যে বা যারা বঙ্গবন্ধু ও ফিদেলের এই ছবিটি দেয়ালে সাটিঁয়েছেন তাঁদেরকে আমার মনের গভীর থেকে সমর্থন করলাম। পরিচয় জানতে পারলে তাদেরকে ধন্যবাদ দিতাম। নিদেনপক্ষে প্রেসক্লাবের কেন্টিনে নিয়ে উন্নতমানের কাবাব ও নান খাওয়াতাম।
বাংলাদেশের এক শিক্ষা ভবনের দেয়ালে ফিদেলের বাণীসমেত জাতিরজনকের ছবি। এতে কিছুই যায় আসে না, ফিদেল বা কিউবাবাসীর। কিন্তু আজ এ লেখাটা লিখতে বসে অজান্তেই ভেসে উঠলো শিক্ষা ভবনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফিদেলের সেই অমৃতবাণী। যারা দেয়ালে লিখেছেন তারা ছাত্রলীগ বা সাবেক ছা্ত্রলীগ বা যুবলীগের কেউ হবেন হয়তো। বাম ঘরানার কেউ হতে পারেন। তবে, তারা কেউ হয়তো জানেন না যে সারা কিউবায় ফিদেলের নামে একটি রাস্তাও নেই। তাঁর নামে নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুল-কলেজ। অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েকবছরের মধ্যে ১০ হাজার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ফিদেল তাঁর দেশে শিক্ষিতের হার ৯৮ শতাংশে নিয়ে গেছেন।
কাকতালীয়ভাবে শিক্ষা ভবনের যে দেয়ালে কাস্ত্রোর বাণীসমেত ছবি সেই ভবনের পেছন দিকটায় শিক্ষা অধিকার চত্বর। আবদুল গণি রোড থেকে হাইকোর্টের পথ ধরে গোলচক্করে। যাদের ত্যাগ স্মরণ করতে শিক্ষা অধিকার চত্বর ও ১৪ ই ফেব্রুয়ারি স্মরণীয় তাদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী চে, কাস্ত্রো ও বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুসারী।
আজ শনিবার ২৬ নভেম্বর সকালে কাস্ত্রোর দেহত্যাগের খবরটা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবকে ফোন দিলাম। আমি ভালোভাবে জানি তিনি কাস্ত্রোভক্ত। শিক্ষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী ও শিক্ষা অধিকার চত্বরের সঙ্গে এই অতিরিক্ত সচিবের প্রাণের টান রয়েছে।
গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির বদলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রচিত হয়েছিল স্বাধীনতা উত্তরকালে উত্তাল তারুণ্যের এক অগ্নিঝরা দিন। কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সেদিন প্রাণ দিয়েছিল জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা, মোজাম্মেলসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই গৌরবময় দিনটি যেখানে হতে পারত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সমুন্নত করা, বৈষম্যের শিক্ষানীতিকে রুখে দেবার প্রেরণা কিন্তু তা না হয়ে ভোগবাদী সংস্কৃতির কদর্যতায় এই দিনটিকে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত ‘ভালোবাসা দিবসের’ জোয়ারে মধ্য ফেব্রুয়ারির ভালোবাসার মানুষগুলো হারিয়ে যেতে দেখে মন খারাপ হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন একটি অফিসে কর্মরত এই অতিরিক্ত সচিবের। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো সেই মিছিলে আলোচিত এই অতিরিক্ত সচিবও অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজ ভোরে তিনি আমাকে জানালেন সাম্যবাদের স্বপ্নচারীদের নায়ক ফিদেলের দেহত্যাগের খবরটা শুনে তিনি তার পূর্ব নির্ধারিত সব কাজ বাদ দিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসেছেন। বিবিসি, সিএনএনসহ দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে যেখানে যা দেখাচ্ছে তা-ই দেখছেন বুঁদ হয়ে।
তিনি আমাকে আরো জানালেন, “পৃথিবীজোড়া বটবৃক্ষের মতো ছিলেন তিনি। দূরে থেকেও অতি কাছের। প্রেরণা যোগাতেন। চলে গেলেন সারাবিশ্বের বিপ্লবীদের শেষ ভরসার কিংবদন্তীর এই নেতা।” তাঁর গলায় জড়তা নেমে আসায় ফোনের লাইনটা কেটে দিলাম।
বিপ্লব স্পন্দিত মনে বললাম “ফিদেল তোমায় লাল সালাম। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।”
সিদ্দিকুর রহমান খান: সম্পাদক, দৈনিকশিক্ষাডটকম।