হাতে ফাইল নিয়ে শিক্ষা অফিসের মাঠের এক কোনায় গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। ঘামে ভিজে ফাইলটি অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বসতেই শুরু করেন তার দুঃখের কথা। তিনি হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। পাঁচ বছর ধরে রংপুরে শিক্ষা অফিসে ঘুরছেন এমপিওভুক্তির জন্য। তার অভিযোগ, কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতিবার অনলাইনে করা আবেদন বাতিল করা হয়। আবদুর রাজ্জাক মাহিগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের কথা শুনে কী লাভ? শিক্ষা অফিসে ঘুরতে ঘুরতে স্যান্ডেল ক্ষয় হয়ে গেল, কিন্তু কোনো কাজই হলো না। অফিসের কর্মকর্তারা আমাকে দেখলেই বলেন, এখন সময় নেই কথা বলার, পরে আসেন। জীবনে মনে হয় বড় পাপ করেছি শিক্ষকতা পেশায় এসে।’
আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, প্রথমবার অনলাইনে আবেদন করার পর শিক্ষকদের তালিকায় নাম না থাকায় বাতিল করা হয় তার ফাইলটি। আবার আবেদন করার সময় বলা হয়, পোস্ট নেই, তাই রিজেক্ট করা হলো। পরে আবারও আবেদন করলে বলা হয়, ওই পদে লোক রয়েছে। অথচ ওই পদে লোক পাঁচ বছর আগে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। সে-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেওয়ার পরও তার ফাইল বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় ধাপে ধাপে অর্থ দেওয়ার পরও কাজ হচ্ছে না। এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শুধু আবদুর রাজ্জাকই নন, এমপিওভুক্তির জন্য অনেক শিক্ষক আসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের রংপুর আঞ্চলিক অফিসে। দিনের পর দিন ঘুরেও কোনো সমাধান হয় না তাদের সমস্যার।
চৌধুরানী উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফারুখ হোসেন চার বছর ধরে ঘুরেও এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। অনলাইনে নিবন্ধন করা হলে একেক সময় একেক ধরনের সমস্যা দেখিয়ে ফাইলটি বাতিল করা হয়। তিনি বলেন, এমপিওভুক্তির জন্য যদি বছরের পর বছর ঘুরতে হয়, তাহলে শিক্ষিত জাতি কীভাবে গড়ে উঠবে?
বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের চার শিক্ষক তিন বছর ধরে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করছেন। বারবার কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হচ্ছে আবেদন। বাংলার শিক্ষক মোখলেছুর রহমান জানান, তিন বছরের বেশি সময় ধরে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করছেন; কিন্তু হচ্ছে না। এ পর্যন্ত তার দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চাঁপাইদহ বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক শাহ আলমও ছয় বছর ধরে ফাইল নিয়ে ঘুরছেন; কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর প্রথমে উপজেলা শিক্ষক অফিসে গিয়ে ফাইলটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য টাকা দিতে হয়। সেখান থেকে যায় জেলা শিক্ষা অফিসে। সেখানেও একই অবস্থা। টাকা না দিলে ফাইল ছাড়া হয় না। সেখানে ফাইলটি ছেড়ে দিলে মাউশি অফিসে টাকা না দিলে ফাইল রিজেক্ট করা হয়। ফাইলটি ওই পর্যন্ত নিয়ে যেতে পরিশ্রম ও খরচ সব মাটি হয়ে যায় বলে জানান শিক্ষক ফারুখ হোসেন।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাসুম হাসান বলেন, শিক্ষক এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইন পদ্ধতিতে আবেদনে জটিলতা রয়ে গেছে। সামান্য একটু ভুলের কারণে আবেদন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া টাকা-পয়সার লেনদেনের বিষয় তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ মিঞা বলেন, নিবন্ধনে টাকা-পয়সা খরচের পাশাপাশি হয়রানি হতে হচ্ছে শিক্ষকদের। বারবার আবেদন রিজেক্ট করা হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন শিক্ষকরা। অবৈধ লেনদেন বন্ধ এবং সহজ পদ্ধতিতে শিক্ষক এমপিওভুক্তির দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম জানান, এখন শিক্ষক নিবন্ধন হয়রানি অনেক কমে গেছে। অবৈধ লেনদেনের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, কাগজপত্র ঠিকভাবে না দিয়েই অনেকে আবেদন করেন। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে। তাই একার পক্ষে কাউকে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য জেলার চেয়ে রংপুরে শিক্ষক এমপিওভুক্তি বেশি হচ্ছে। এবার ২৫০ শিক্ষক এমপিওভুক্তি হয়েছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তাক হাবীব বলেন, সবকিছুর একটা নিয়ম রয়েছে। নিয়মের বাইরে তো কেউ নয়। আবেদনে যেসব প্রয়োজন তা যদি ঠিকভাবে কেউ দেন, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি অর্থ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সূত্র: সমকাল