রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা - দৈনিকশিক্ষা

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

গোলাম কবির |

রবীন্দ্রনাথ জীবন আর জগতের কোনো কিছুকে তুচ্ছ করে দেখার কথা ভাবতেন না। একদা তুচ্ছ বলে যা চাননি, তাকেই আবার আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন দুই বাহু বাড়িয়ে (দুর্লভজন্ম)। এর সামান্য আগে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, ‘কী গভীর দুখে মগ্ন সমস্ত আকাশ সমস্ত পৃথিবী’ (যেতে নাহি দিব)। জোড়াসাঁকোয় বসে যখন কবি এই ভাবনায় ভাবিত তখন তাঁর বয়স ৩১ বছর অর্থাৎ যৌবন তখনো পায়ে পায়ে। অথচ ধরণিকে দেখলেন গভীর দুঃখে মগ্ন। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ একই মানুষের মুহূর্তের মধ্যে মনের আকাশের রং বদলায়। রবীন্দ্রনাথের এই দুঃখবোধ অবশ্য রং বদল নয়, কারণ দুঃখ অনুভূত না হলে সুখ ধরা দেবে কিভাবে!

রবীন্দ্রনাথ ইহবাদী ও আশাবাদী কবি। স্বর্গের চেয়ে তাঁর কাছে ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বাড়া (স্বর্গ হইতে বিদায়)। সেই সঙ্গে আশায় বুক বেঁধে ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে’ বলে হতাশদের প্রণোদিত করতে চেয়েছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পত্রপুটের কাল থেকে পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে।

হবেই তো, মন যে বহতা নদীর মতো! তা ছাড়া পারিপার্শ্বিকের অভিঘাত তো আছেই। তাই সারা জীবনের সঞ্চিত আশাবাদ তাঁর ব্যাহত হতে থাকে। কৈশোরে জননীর অকালবিদায়, জনকের পরলোক যাত্রা, স্ত্রী-সন্তানাদির সময়ের আগেই চলে যাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলেন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ প্রথম মহাযুদ্ধ। ক্ষমতার লড়াই কিভাবে মানুষকে পাশবিক করে তোলে, তা রক্তাক্তভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। এ দেখার মধ্যে আনন্দের লেশমাত্র কই? তখনো কবি বারেকের জন্য বলেননি, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’।

তিরিশোত্তীর্ণ কবির পূর্ব বাংলায় আসার পর প্রশান্তিতে হৃদয় জুড়িয়ে গিয়েছিল (আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো—খেয়া)। এ সময়ে তিনি যা পেয়েছেন, যা দেখেছেন, তাকেই তুলনাহীন মনে করেছেন (যা দেখেছি যা পেয়েছি/তুলনা তার নাই—গীতাঞ্জলি)। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে’ (গীতবিতান)। কবির সে প্রত্যয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশের সময় লক্ষ করা গেছে দেশের জন্য কবির গভীর আশাবাদ। সরকারের কাছে দেনদরবারের চেয়ে নিজেদের উন্নয়নের জন্য নিজেদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, শিক্ষার কথাও তিনি ভেবেছেন। শতবর্ষেরও আগে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠার দিকে তাকিয়ে নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরামর্শই শুধু দেননি, নিজেই আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রবল শিক্ষানুরাগ। আজকের শিক্ষা ব্যবসা আর শিক্ষার নামে অপচয় দেখলে তিনি দীর্ঘজীবনকে কোন অভিধায় অভিহিত করতেন?

অতুলপ্রসাদ সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ। তাঁর জন্ম রবীন্দ্রনাথের ১০ বছর পর। সংগীত সাধক এই গুণী মানুষটি তাঁর আগেই চলে গেলেন। তাঁর এই চলে যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ এমনই বেদনাহত হয়েছিলেন যে তাঁর প্রয়াণকে সামনে রেখে ‘অতুলপ্রসাদ সেন’ নামে একখানা দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন (কবিতাটি ‘পরিশেষ’ কাব্যের সংযোজনে স্থান পেয়েছে)। কবিতায় তিনি তাঁর তাপদগ্ধ জীবনের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা হয়তো স্মরণে এনে লিখেছিলেন, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’। কবির অবচেতনে থাকা এই অমোঘ বাণী আমাদের বিশ্বাসের ভিতকে কিছুটা হলেও নাড়া দেয়। কেননা তিনিই একদা আমাদের ‘আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু’র জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে বলেছিলেন। অথচ অস্তায়মান বেলায় কবি সেই আয়ুর দীর্ঘতর হওয়াকে ভাবলেন দীর্ঘ অভিশাপ। সাধারণ বিচারে অনুভবটি স্ববিরোধ মনে হতে পারে। মানবচিত্তে সু-কু, আনন্দ-বেদনা সমান্তরালভাবে চলে। পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে অনুকূলের ভাবটি প্রাধান্য পায়। রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র দুঃখের মুখোমুখি হয়েছেন, আত্মজদের অকালবিদায় দেখেছেন, জামাতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ অশালীন আচরণ বহন করেছেন, তাতে তিনি বিমর্ষ হয়েছেন; কিন্তু অধিককাল বেঁচে থাকাকে অভিশাপ ভাবেননি। বিদায় নেওয়ার আগে সংগত কারণেই ভাবলেন ‘অভিশাপ’! জীবনের একটি পর্যায়ে অনেক মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাকে দুঃসহ ভাবে। সুতরাং এ ভাবনা স্ববিরোধ নয়।

আমাদের দেশের শিক্ষার এই যে অধঃপতন, যা প্রত্যক্ষ করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে মুখ খুলতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ প্রজ্ঞাহীন শিক্ষকের ফলবিহীন শিক্ষা প্রত্যক্ষ করে শিক্ষা নিয়ে ভাবিত মানুষ হয়তো নিজের অজ্ঞাতে উচ্চারণ করবেন ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’। তবে অভিশাপ থেকে একসময় মুক্ত হওয়া যায়। যাকে বলে শাপমোচন। পুনশ্চ কাব্যে রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা আছে।

রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক সভা-সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তখন ভারত ছিল পরাধীন। তখনকার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মূল ভাবনা ছিল স্বাধীনতা। আর এই চেতনা শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি জনগণকে দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার দীক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন অপরিহার্য মনে করেছিলেন। আমরা উল্টো পথে চলছি। ছাত্র-শিক্ষক যৌথভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শিক্ষকদের শুভকর্মে তাঁদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯০২ সালে তিনি শিক্ষকদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অধ্যাপকগণকে আমি আমার অধীনস্থ বলিয়া মনে করি না। তাঁহারা স্বাধীন শুভবুদ্ধি দ্বারা কর্তব্য সম্পন্ন করিয়া যাইবেন ইহাই আমি আশা করি এবং ইহার জন্যই আমি সর্বদা প্রতীক্ষা করিয়া থাকি’ (‘রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ২৪, পৃষ্ঠা ১০৬৫)। বঙ্গবন্ধুও ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে সে বিশ্বাস নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমরা তার মর্যাদা রক্ষা করিনি। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য বিবেক বিসর্জন দিয়ে চলেছি। এ যেন ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। পার্থক্য, জমিদারদের নির্ধারিত পরিমাণ কর দিতে হতো। শিক্ষকদের তা লাগে না। তাঁরা নিজেরা ভোগ করছেন স্বাধীনভাবে নিজেদের সব সুবিধা করে নিয়ে এবং ছেলে-মেয়ে-জামাতা-পৌত্রাদির জন্য স্থান সংরক্ষণ করছেন। সেখানে মেধা নয়, অনৈতিক অধিকার শীর্ষে। আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ বর্তমান থাকলে অভিশাপের পরিবর্তে এ অবস্থানকে দীর্ঘ পরিহাস ভাবতেন। আমাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যেকোনো মূল্যে। তা না হলে শিক্ষার অগস্ত্যযাত্রা ঠেকানো কঠিন হবে।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034019947052002