এক সময় যারা শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখত, তাদের মুখে মুখে তখন শোনা যেত—
‘লেখা-পড়া করে যে
গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’
এ কথাটি তখন উদ্দীপনা জাগানোর মন্ত্র ছিল। কচি কচি শিশুদের হাতে-খড়ির সঙ্গে সঙ্গে ওদের মনে হতো, একদিন বড় হবে—গাড়ি-ঘোড়া চড়বে। তাই বই হাতে নিয়ে শুরু করত অ—আ—ক—খ। স্লেট-পেন্সিল নিয়ে এঁকে এঁকে একাকার করে ফেলত। স্বপ্রণোদিত হয়ে মাটিতে, দেয়ালে নিজের বিদ্যা জাহির করার প্রচেষ্টা চালাত।
সন্তান যখন অক্ষর চেনায় ব্যস্ত, তখন অনেক মা-বাবা পর্যন্ত অতিথিদের সামনে তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। শিশুরাও সুরে-বেসুরে পড়ার মাঝে একটা আনন্দ খুঁজে পেত। পড়া-ভীতি ওদের এত প্রকট ছিল না। আমরা এখন শিশুদের মনে পড়া-ভীতির বীজ উপ্ত করছি। স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলে পেট ব্যথা, মাথাব্যথা হরদম লেগেই থাকে।
এত এত বই ওদের পাঠ্য করা হয় যে, ওরা পড়া রপ্ত করতে গিয়ে হিমশিম খায়। ফলে স্কুলে যাওয়ার পর যে বকুনি-পিটুনি অপেক্ষা করবে, সে ভীতিতেই কাবু হয়ে পড়ে।
সরকার থেকে একটা শিশুর বয়স ও মেধানুযায়ী সিলেবাস প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, সরকারি রীতিনীতি এড়িয়ে চলে। বরং যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি কঠিন বই বাচ্চাদের চাপিয়ে দিতে পারে, সে প্রতিষ্ঠানই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়। এই সমস্ত মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর বেতনও বেশি ধার্য করা হয়। কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ শিশুদের শিখিয়ে অভিভাবকদের তাক লাগিয়ে দেওয়া হয়। অভিভাবকরা চড়া বেতনে বাচ্চাকে ওইসব স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সন্তানের জন্য মা-বাবা তাদের কষ্টার্জিত টাকা অকৃপণভাবে খরচ করেও তৃপ্ত হন এই ভেবে, তাদের সন্তান এসব শব্দের অর্থ বলতে পারবে।
অনেক নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি, সেখানে শিক্ষার্থীদের পিঠে এক বোঝা বই চাপিয়ে দেওয়া হয়। অনেক অভিভাবক আছেন, যারা সন্তানের কঠিন কঠিন বইগুলো নিজেরাও বুঝতে পারেন না। ফলে বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এমনি একটা অসুস্থ পরিবেশে বাচ্চারা বেড়ে উঠছে। বইয়ের বোঝা পিঠে চাপিয়েও বাচ্চাদের অসুস্থ করে তোলা হচ্ছে। কঠিন কঠিন বই আর কঠিনতর সিলেবাস নিয়ে খেয়ে না খেয়ে সাত সকালে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হয় স্কুলের দিকে অথবা কোনো কোচিং সেন্টারে নামিদামি কোনো শিক্ষকের কাছে। যে বয়সে ওরা পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চাইবে, প্রজাপতির মতো নেচে-গেয়ে স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াবে, সেই বয়সে অতিরিক্ত বই-এর চাপে আর পরীক্ষা নামক বিভীষিকায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বই পড়ার মধ্যে যে একটা আনন্দ আছে, সে আনন্দ থেকে শিশুরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।
আমি আমার ক্ষুদ্র পরিসরে শিশুদের বই-এর বোঝা আর পরীক্ষার বিভীষিকা থেকে মুক্ত করার পথ খুঁজতে লাগলাম। আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে যখন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি, তখন বুকলিস্ট থেকে সরকার নির্ধারিত বইয়ের অতিরিক্ত সব বই বাদ দিয়ে দিলাম।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চাদের প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করলাম। শিক্ষকদের নির্দেশ দিলাম, ভয়-ভীতি না দেখিয়ে আনন্দের সঙ্গে পড়াশুনা শেখাতে। কিন্তু পরীক্ষা বর্জন নীতিতে বাদ সাধলেন অভিভাবকরা। তাদের কথা হলো, ‘সব স্কুলে বাচ্চারা পরীক্ষা দেয়, শুধু আমাদের বাচ্চারা পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হবে কেন? পরীক্ষা না নিলে আমরা আমাদের বাচ্চাদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাব।’
অগত্যা ওই নীতি চালু করতে পারলাম না বটে, তবে শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়ে দিলাম, যেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বাচ্চাকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করে দেওয়া না হয়। কারণ, আমি মনে করি, জীবনের প্রথম বেলায়ই যদি অকার্যকারিতা দিয়ে শুরু হয়, তাহলে একটা প্রচণ্ড মানসিক চাপ পরবর্তী জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। যে কোনো কাজ করার আগে মনে হতে পারে, আমি পারব কী?
এই অস্বস্তিকর পরিবেশে যাতে পড়তে না হয়, সেজন্যে জীবনের প্রথম বেলায় পড়াশুনাকে যেন চাপ হিসেবে না নেয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
পরীক্ষা দেওয়া আর পরীক্ষা পাসই যদি হয় জীবনের মূলমন্ত্র, তাহলে পড়াশুনাকে কেউ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে না। এতে স্বপ্ন দেখার আনন্দও কমে যাবে।
লেখা-পড়া করে গাড়ি-ঘোড়া চড়বে, এটা একটা সুস্বপ্ন ছিল। তাই আনন্দের সঙ্গে পড়াশুনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করত। আজকের দিনে লেখা-পড়া করে কী হবে—সে স্বপ্ন যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পড়াশুনা যেন মনকে ছুঁয়ে যায় না। সবাই পড়ে—তাই পড়তে হবে। পরীক্ষা পাসের জন্যে পাঠ্য বই-ই যথেষ্ট। সহপাঠ বই তাই দৃষ্টি থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ছেলেমেয়েরা স্বউপার্জিত জ্ঞান অর্জনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখনও সময় আছে, ছেলে-মেয়েদের পড়া-ভীতি কমিয়ে তাদেরকে পড়াশুনার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। সযত্নে তুলে রাখা ধূলা-ময়লা মাখা বইগুলোকে ঝেড়ে-মুছে ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দিতে হবে। পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে সহপাঠ বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমাদের ছেলে-মেয়েদের মন উদার হবে—তারা কিছু একটা করার প্রেরণা খুঁজে পাবে। আবার তারা স্বপ্ন দেখার স্বাদ খুঁজে পাবে।
লেখক: প্রাক্তন উপদেষ্টা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ