শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক—এই তিনটির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষক হলো মূল্যবোধ বিনির্মাণের আদর্শ কারিগর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মূল্যবোধ চর্চার অনন্য কারখানা। শিক্ষা ভালো-মন্দ বিচার করতে শেখায়। আর এই ভালো-মন্দের বিচার মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। একটি সুস্থ, সুন্দর ও মানুষের উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ ও রাজনীতিসহ সর্বত্র মানবজীবন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
নীতিবিদ্যায় মূল্যবোধকে গুরুত্বের মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়—যার লক্ষ্য হচ্ছে কোন কাজটি করা ভালো বা কোন ধরনের জীবনযাপন করা ভালো, তা নির্ধারণ করা। মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন—নৈতিক মূল্যবোধ, পেশাগত মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নান্দনিক মূল্যবোধ ইত্যাদি। একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য সব ধরনের মূল্যবোধের সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃত উত্স হলো নৈতিক চেতনা। নৈতিক চেতনা হলো মানুষের অন্তস্থ এক শক্তি। এটি ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঔচিত্য-অনৈচিত্যের মধ্যে পার্থক্যবোধ সৃষ্টি করে। জীবন চলার পথে মানুষকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে কী করা উচিত বা উচিত নয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো ব্যক্তির এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর তার জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। তাছাড়া এই সিদ্ধান্তের যথার্থতা ব্যক্তির জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ করে। নৈতিক মূল্যবোধ এমন এক অনন্য শক্তি, যা প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে। এ শক্তির মাত্রার দিক থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এই অনন্য অন্তর্শক্তি প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই কমবেশি অবস্থান করে।
নৈতিক মূল্যবোধের ফলে সমাজ বহু সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মুক্তি পায়। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ উন্নয়নের একটি প্রধান পূর্বশর্ত। যে জাতির নৈতিক মূল্যবোধ যত বেশি জাগ্রত হয়, সে জাতি তত বেশি উন্নত—এই সত্যটির পক্ষে সকল চিন্তাশীল মানুষই একমত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসনের জন্য নৈতিক মূল্যবোধ অনন্য ভূমিকা পালন করে। এর ওপর একটি জাতির সভ্যতা, নৈতিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল শ্রেণির মানুষের দক্ষতা বিশেষজ্ঞতাই যথেষ্ট নয় বরং তারা কতখানি নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা সঞ্জীবিত হয়েছে, সেটাই হলো বড় কথা। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে অন্যায়ের পতন ঘটাতে চেতনার জোগান দেয়। স্বার্থপরতা, আত্মবাদিতা ইত্যাদি সংকীর্ণ চিন্তা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে দেয় প্রবল ও দৃঢ় মানসিক শক্তি, যার ফলে মানুষ যাবতীয় দুর্নীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শেখে; অন্যায় ও অবৈধ পন্থা পরিত্যাগ করে নৈতিক ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের চরিত্রের উত্কর্ষ সাধন করে। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ যতই বৃদ্ধি পায়, ততই সমাজ-জীবন হয়ে ওঠে কুলুষমুক্ত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই কারণে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের উত্সারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা।
যে কোনো পেশায় সফলতা পেতে হলে পেশার প্রতি দায়িত্বশীল থাকতে হয়। অর্থাত্ কিছু নৈতিক আচরণ পালন বা অনুসরণ করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় পেশাগত মূল্যবোধ। এই নৈতিক আচরণকে পেশার মান বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিচার করা হয়। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এই পেশাটি অন্য আট-দশটি পেশা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ পেশায় পেশাগত মূল্যবোধ খুবই জরুরি।
আমাদের সমাজে বর্তমানে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় চলছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণেধরা মূল্যবোধকে শিক্ষক সমাজই আবার জাগিয়ে তুলতে পারেন। শিক্ষার্থী, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রধান কর্ণধারের ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষক সমাজকেই।
ময়মনসিংহ