জাতির গড়ার কারিগর বলা হয় শিক্ষককে। সেই শিক্ষকদেরই কেউ কেউ মানসিক, নৈতিক, চারিত্রিক, আর্থিকসহ নানা কুকর্মে লিপ্ত হয়ে দুর্নাম কামাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যরাও জড়িত হয়ে পড়ছেন এসব অপকর্মে। এমনকি যে বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি একজন নারী সে স্কুলের ছাত্রীরাও যৌন হয়রানি শিকার হয়েও ভয়ে মুখ খুলছে না। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। ছাত্রী ও অভিভাবকরা হয়ে পড়ছেন ভীত-উদ্বিগ্ন।
দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানের জানা যায়, চলতি অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে ৩১টি। আবার জমা হওয়া অভিযোগ তালিকাভুক্ত না করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের ভালো যোগাযোগ থাকলে অভিযোগের কপি গায়েব করা হয়।
এছাড়াও নির্যাতিত কিন্তু অভিযোগ জমা দেননি। মেয়েদের আর পড়াবেন না। গ্রামের বাড়ীতের পাঠিয়ে দেবেন অথবা বিয়ে দিয়ে দেবেন এমন কয়েকটি ঘটনার সব তথ্য প্রমাণ দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে। এ অবস্থা ভয়াবহ বলে মনে করছেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষাবিদরা বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মহান এ পেশায় কিছু কুলাঙ্গার ঢুকে পড়েছে; যারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নিয়োগের সময় এদের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা হয়না। ফলে পরিচয় ও তথ্য গোপণ করে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়ছেন অনেকেই।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত করে প্রমাণ মিললে দোষীদর বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের সচেতনতাবোধ জাগ্রত করা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। ছাত্রীদের নিরাপত্তায় দেশব্যাপী মানবন্ধন ও আলোচনা সভা করবেন শিগগিরই।
দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি মাসেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর বাইরে শিক্ষকদের কাছে ছাত্রী নিপীড়নের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রীরা শিক্ষকদের কাছেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঘটনাগুলো তদন্তে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পুরো বিষয়টি তদারক করবেন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।
রাজধানীর উদাহরণ: শিক্ষা মন্ত্র্ণালয়ে জমা হওয়া অভিযোগে জানা যায়, পুরান ঢাকার আনন্দময়ী স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক জসিম স্কুলের পাশেই একটি বাড়ীতে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন। ছাত্রীদের বাধ্য করেন ওই কোচিংয়ে যেতে। শ্লীলতহানীর শিকার হয়ে গত তিনমাসে অন্তত ৩ জন ছাত্রী স্কুল ছেড়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে স্কুলের নারী শিক্ষকদের ডেকে অভিভাবকরা বলেছেন তাদের মেয়েদের কঠিন অসুখ হয়েছে তাই গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয় হবে। আর পড়াশোনা করাবেন না। অভিযুক্ত জসিম দুই বছর আগে যোগ দেন এ বিদ্যালয়ে। তার আগে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার কেরানীগঞ্জের একটি স্কুল থেকে চাকরি হারাতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক জসিমকে রক্ষার জন্যই ম্যানেজিং কমিটি ও কয়েকজন শিক্ষক উঠেপড়ে লেগেছে। জসিমকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মাত্র। এলাকাবাসী ও কিছু সচেতন অভিভাবক এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন। আবেদনে উল্লেখ করেছেন, ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়গুলো যেন মামলা মোকদ্দমা বা গণমাধ্যমে প্রকাশ না হয় সে বিষয়ে সব শিক্ষকদের কাছ থেকে লিখিত নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ছাত্রী পাওয়া যাবে না্। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়া ছাত্রীদের অনুপস্থিতি ধরা না পড়ার উপায় হিসেবে কয়েকজন শ্রেণি শিক্ষক পাল্টে দিয়েছেন। সভাপতির নিজস্ব মতাদর্শের শ্রেণি শিক্ষকরা দিনের পর দিন অনুপস্থিত ছাত্রীদের তথ্য গোপণ করে তাদেরকে উপস্থিত দেখিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির [এডহক] সভাপতি একজন বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা ও প্রেষণে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শাখার কর্মকর্তা। অভিযুক্ত শিক্ষক জসিম সভাপতির বাসার গৃহশিক্ষক ছিলেন। আজ রোববার নানা অভিযোগ নিয়ে এডিসি শিক্ষার দরবারে হাজির হবেন অভিভাবকরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বারবার অভিযোগ জমা দেয়া হলেও তা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগকারীরা বলেছেন।
গাজীপুরের ঘটনা: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া অভিযোগগুলোর মধ্যে বেশ কিছু স্পর্শকাতর ঘটনা রয়েছে বলে জানা গেছে। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বড়হর আবদুল মজিদ মোল্লা বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে এই অভিযোগ করেন এক ছাত্রীর বাবা। অভিযোগে বলা হয়, ৮ অক্টোবর ওই মাদ্রাসার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষে আটকে যৌন হয়রানি করেন মাদ্রাসা সুপার শহীদুল্লাহ। ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে সুপার বলেন, ‘ইহা আধ্যাত্মিক ফয়েজ প্রদান।’ দশম শ্রেণির অপর এক ছাত্রীকেও তিনি যৌন হয়রানি করেন। আরেক ছাত্রীকে ওই সুপার ক্লাসরুমে প্রকাশ্য প্রেমপত্র পাঠ করতে বলেন। সুপার শহীদুল্লাহ অভিনব পদ্ধতিতে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেন বলেও অভিযোগ করা হয়। মন্ত্রণালয় গাজীপুরের জেলা প্রশাসককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
ওই মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. ওয়াজ উদ্দিন মোল্লা বলেন, এসব বিষয়ে এর আগেও সুপারকে সাবধান করা হয়েছে। তারপরও তিনি এসব কর্মকাণ্ড করেছেন। তার বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। অভিযুক্ত সুপার শহীদুল্লাহ ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে। কাপাসিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওই সুপারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।
ধর্ষণের ভিডিও করে ১৯ ভরি স্বর্ণ আদায়: এ ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার। অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ূয়া এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে তার ভিডিও ধারণ করে গৃহশিক্ষক সমীর দত্ত (৩৯)। এরপর শুরু করে ব্ল্যাকমেইল। এ পর্যন্ত ওই ছাত্রীর কাছ থেকে ১৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ২৫ হাজার টাকা আদায় করেছে লম্পট ওই শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘটনাটি তদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছে। অভিযোগ থেকে জানা যায়, জনৈক ব্যবসায়ীর মেয়েকে চতুর্থ শ্রেণি থেকে বাসায় গিয়ে পড়াত শিক্ষক সমীর। ওই মেয়েটি এখন স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন। ওই ছাত্রীর সঙ্গে শহরের এক যুবকের ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে মনোমালিন্য হলে মেয়েটিকে বিভিন্ন কবিরাজের কাছে নিয়ে যান সমীর। সরলতার সুযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে স্থানীয় এক বাসায় নিয়ে সমীর ওই ছাত্রীকে ধর্ষন করে। একপর্যায়ে মোবাইলে ভিডিও করে। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়াসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেয় সমীর। এরপর আরও নগদ টাকা দাবি করা হয়। বাধ্য হয়ে মেয়ের বাবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের ও থানায় মামলা করেন। পুলিশ অভিযুক্ত শিক্ষককে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে।
নীলছবির ছড়াছড়ি: ছাত্রীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের অজ্ঞাতে এখন পর্যন্ত ১৮টি নীলছবি বানিয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের পইদুল ইসলাম নামের এক শিক্ষক। সে সদর উপজেলার ৯ নম্বর রায়পুর ইউনিয়নের মটরা এলাকার বাসিন্দা। পইদুল ২০১১ সালে ভগদগাজী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। এরপর থেকেই সে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে। পরে ওই ভিডিও দেখিয়ে সে তাদের ব্ল্যাকমেইল করত। গণিতের শিক্ষক হওয়ায় প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে সে এসব অপকর্ম করেছে। অভিযোগ থেকে জানা যায়, চলতি মাসে বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে তার সঙ্গে পইদুল মেলামেশার চেষ্টা করলে বিষয়টি টের পায় ওই ছাত্রীর নিকটজন। ভুক্তভোগী এক ছাত্রী পইদুল ইসলামের মোবাইল ফোন থেকে কিছু ছবি বের করে নেয়। পরে সেসব অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী ১৬ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে ঝাড়ূ মিছিল করেছে। ঠাকুরগাঁওয়ের ডিসিকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলেছে মন্ত্রণালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ: এক ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে দুর্বল মুহূর্তের ছবি ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমেদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার সাবেক স্ত্রী আকতার জাহান জলি আত্মহত্যা করেন। ওই ঘটনায় তানভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগের সহকর্মী ১৬ শিক্ষক লিখিত অভিযোগ এনে তাকে ‘নৈতিকতাহীন’ উল্লেখ করে তার সঙ্গে কাজ করতে আপত্তি তোলেন। তাদের দাবির মুখে ২২ সেপ্টেম্বর বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তানভীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তানভীর আহমেদ কয়েক বছর আগে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ধারণ করে দিনের পর দিন তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন। ওই সময় তিনি আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। ওই শিক্ষার্থী সমকালকে বলেন, ‘যখন জানতে পারি তানভীরের সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক আছে, তখন সরে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু ভিডিওর কথা উল্লেখ করে হুমকি দিতে থাকেন। বলে, যখন ডাকি তখনই আসতে হবে। না এলে ছাত্রলীগের হাতে হাতে ভিডিও দিয়ে দেব। তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব।’
রাবি উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘তানভীরের বিরুদ্ধে জলিকে গালাগালি, অপমান ও অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। রীতিমতো তার বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি মোটা ভলিউম জমা পড়েছে। এসব অভিযোগ সাত সদস্যের কমিটি তদন্ত করে দেখবে।’ তবে তানভীর আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। অভিযোগ থাকলে উপাচার্য আমাকে শোকজ করবেন। আমি জবাব দেব। এসব শোনা কথায় কান দিতে হয় না।’