শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়

বদরুদ্দীন উমর |

২৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে রাজশাহী কলেজের ছাত্রলীগ কর্মীরা একজন শিক্ষককে মারধর করেছে (প্রতিদিনের সংবাদ, ২৯.১১.১৬)। ছাত্রলীগের কর্মীরা কলেজ থেকে একটি মিছিল করার সময় ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী সরকার ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক স্লোগান দেয়ায় দুই সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা ধাওয়া করে ছাত্রদলের কর্মীদের কলেজের এলাকা থেকে বের করে দেয়, এই মর্মে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে কারণে ঘটনাটি সংবাদপত্রে রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তা হল, ছাত্রলীগের কর্মীরা এরপর কলেজে ভাংচুর করে এবং একাধিক শিক্ষককে মারধর করে। পরে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে।

বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলেরও যে চরিত্র তাতে তারা কথিত উসকানিমূলক বক্তব্য দিতেও পারে, যদিও ছাত্রলীগের শক্তিশালী অবস্থানের মুখে তাদের দ্বারা এ কাজ করার সম্ভাবনা কম। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী এ ধরনের কোনো উসকানিমূলক কাজ করেছে, তাহলেও তাদের তাড়িয়ে দেয়ার পর কলেজে ভাংচুর ও শিক্ষককে মারধর করার কোনো গ্রাহ্য যুক্তি একেবারেই নেই। ছাত্রলীগ একটি গুণ্ডাবাহিনী ও সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হওয়ার কারণেই তারা শুধু এই দিনই নয়, দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কাজ করে আসছে। চরম দুর্নীতিবাজ এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা টেন্ডারবাজি থেকে চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। তাদের এসব কাজ থেকে নিবৃত্ত করার কোনো চিন্তা তাদের পিতৃসংগঠন আওয়ামী লীগের নেই। উপরন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার প্রয়োজনে তাদের যথেচ্ছ স্বাধীনতা দিয়েই রেখেছে, যা ব্যবহার করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অবাধে তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস সর্বত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষক মারধরের অপকর্ম আগেও করে এসেছে। কাজেই রাজশাহী কলেজের এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। শিক্ষক অবমাননা ও নির্যাতনের কাজ খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও করে থাকেন। এরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। কলেজ কমিটির মধ্যে গণ্ডগোল থেকে নিয়ে অন্য কারণে আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয়ভাবে শিক্ষকদের মারধর, তাদের পদচ্যুতি ইত্যাদি করে এসেছে।

এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, এভাবে শিক্ষকদের ওপর স্কুল-কলেজে মারধর ও নির্যাতন হলেও শিক্ষকদের নিজেদের কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সমিতি থাকা সত্ত্বেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিই মনে করে না যে, স্কুল-কলেজ শিক্ষকের ওপর এই নির্যাতন হলে শিক্ষক হিসেবে তাদের কিছু করণীয় আছে! সমগ্র শিক্ষা পরিবেশ যে এর দ্বারা দূষিত হয় এবং এ অবস্থা যেখানে বিরাজ করে সেখানে শিক্ষা যে সুষ্ঠুভাবে হওয়া সম্ভব নয়, এসব ভাবনার ব্যাপারও তাদের নেই। এর মূল কারণ শিক্ষকদের নিজেদেরও সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবস্থান আজ নেমে গেছে নিন্মস্তরে। দুর্নীতি সেখানেও হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চর্চিত ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু এটাই হল সাধারণ আচরণ।

আওয়ামী লীগ একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি এখন ভয়াবহভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জ। টেন্ডার ও চাঁদা নিয়ে শুধু যে এখন ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তাই নয়, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার খবরও প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে পাওয়া যায়।

যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের কোনো শ্রদ্ধা শিক্ষকদের প্রতি নেই এবং শিক্ষকদের কোনো প্রেম-ভালোবাসা ছাত্রদের প্রতি নেই, সেখানে শিক্ষা বিষয়ে লম্বা-চওড়া অনেক কথা বললেও প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ থাকা সম্ভব নয়। সেটা নেইও। তাছাড়া সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রী নানা ধরনের আজগুবি নীতি ও পদ্ধতি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে, বিশেষত স্কুল পর্যায়ে কার্যকর করতে নিযুক্ত হওয়ায় সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশে বিপর্যস্ত। শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে এভাবে বিপর্যস্ত এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যেখানে অস্বাভাবিক, সেখানে দেশের পরিস্থিতিও যে এর দ্বারা প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে তা-ই হয়েছে। শিক্ষা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নত করে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা অন্যরকম। একদিকে দেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির চর্চা যেমন শিক্ষার পরিবেশকে বিষাক্ত করছে, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য দাঁড়িয়েছে সেটা সমাজের ওপর নানাভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে।

ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে ব্যবহারিক সংস্কৃতি এখন একেবারে নিন্ম পর্যায়ে নেমে গেছে বললেও কম বলা হয়। সততা যেমন তার প্রভাব সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিস্তার করে, দুর্নীতিও তেমনি, দুর্নীতি আজ সরকার ও শাসন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবং শীর্ষতম পর্যায় থেকে নিন্মতর পর্যায়ে এমনভাবে ঢুকেছে যে, মানুষের আচার-আচরণে সভ্যতার অনুপস্থিতি এক লক্ষণীয় ব্যাপার। মিথ্যাচার এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক জাতীয় অভ্যাস। তাছাড়া মিথ্যা বলতে এবং ভাঁওতাপূর্ণ কথা বলতে অসুবিধা হয় এমন লোকের সংখ্যা সামান্য। সরকারি কর্মকর্তারা অহরহ যে কাজ নিজেরা করেন, সে কাজ করা যে কত গর্হিত ব্যাপার এটা সভা-সমিতিতে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে জোর গলায় বলতে তাদের অসুবিধা হয় না!! এজন্য শাসক শ্রেণীর দলগুলোতে অপরাধী চরিত্রের লোকের অভাব নেই। উপরন্তু তাদের একটা কদরও আছে।

এভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের অভাবে কিছুদিন টিকে থাকা যায় এবং নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধ করা যায়, কিন্তু সামাজিক নিয়মেই এটা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার নয়। বাংলাদেশেও এখন বাইরের প্রতিরোধ ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করে রাখা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণভাবে সংকট তৈরি হচ্ছে। দুর্নীতি, দমনপীড়ন ও সন্ত্রাস শাসন ব্যবস্থার মধ্যে যে ভাঙন ডেকে আনছে, তার পরিচয় নানা ঘটনার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পারস্পরিক সংঘর্ষ এবং খুনখারাবির সংবাদ এখন নিত্যকার ব্যাপার। প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীও এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধের থেকে মুক্ত নয়। পুলিশের নিজেদের মধ্যেও ঝামেলা আছে। তাছাড়া পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যেও যে দ্বন্দ্ব এখন দেখা দিয়েছে এটা আইনশৃংখলা বাহিনীর অভ্যন্তরে ভাঙনেরই প্রতিফলন। এ অবস্থায় বর্তমানে বাংলাদেশে যে ‘স্থিতিশীলতা’ এখন দেখা যাচ্ছে এটা বিভ্রান্তিমূলক। এক ধরনের ফ্যাসিস্ট দমনপীড়নের মাধ্যমে এই ‘স্থিতিশীলতা’ এখনও পর্যন্ত রক্ষিত হলেও আসলে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা এখন একটা আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর বিস্ফোরণ বাংলাদেশের জন্য কোনো সুখকর ব্যাপার হবে না।

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066449642181396