বায়ান্নর একুশ আমাদের জাতীয় জীবনের অহঙ্কার। একুশ আমাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। আরো শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। একুশের রক্তদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপনের সূচনা। সালাম, বরকত,রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অগুনিত শহিদের রক্তে ভেজা এ একুশ। আজ একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে সমাদৃত। পৃথিবীর অন্য কোন জাতিকে মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য রক্ত দিতে হয়নি। আজকে শিশু শিক্ষার মাতৃভাষা বাংলা দারুণ ভাবে অবহেলিত।
নামিদামি বিদ্যালয় নামে খ্যাত ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় গুলোতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা অনেকটা অকার্যকর করে তুলছে। এসব বিদ্যালয়গুলোতে শিশু শিক্ষার সূচনালগ্ন থেকে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দ মুখস্ত করানো হয়। আমাদের দেশের শিক্ষিত নামে পরিচিত কতিপয় মূর্খ তাদের উৎসাহিত ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়গুলোতে শিশুর মেধা বিকাশের পরিবর্তে মননশীলতা সঙ্কুচিত হচ্ছে। অভিভাবকদের মাঝে বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা কাজ করছে। বেশি বেশি বই পড়লে শিশু তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে ফেলবে। বাস্তবে শিশুর শিক্ষা বয়স, রুচি ও সামর্থনুযায়ী হলে তা হবে অধিকতর জ্ঞান অর্জনমূখী।
এর বাইরে শিক্ষাদান করা হলে শিশু লেখা পড়ায় অমনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি তার মধ্যে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হবে। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সন্তানকে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি না করতে পেরে আক্ষেপ করে বলেছেন এত ‘‘নামিদামি বিদ্যালয়ে সন্তানকে শিশুকাল থেকে ইংরেজি পড়ালাম তবুও কেন ভর্তি হতে পারেনি? বিষয়টি বোধগম্য নহে। বন্ধুর কষ্ট ও ব্যাথা প্রসঙ্গে বলতে হয় পুষ্টিবিহীন খাদ্য যেমন শরীরের কোন কাজে লাগেনা, তেমনি না বুঝে মুখস্ত করা মাতৃভাষা বিহীন জ্ঞান অর্জন খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। বিষয়টি অনেকটা দাঁত বিহীন শিশু বা ব্যক্তির হাড় চিবিয়ে খাওয়ার মতো।
সাধারণত শিশুর দাঁত যখন মজবুত হয়, তখন আমরা শিশুকে শক্ত খাবার খেতে দেই। শিশু তখন তা অনায়াসে খেয়ে ফেলে। মাতৃভাষায় ভাল জ্ঞান অর্জন হলে বিদেশি ভাষায় দক্ষতা অর্জন সহজতর হবে। আজকের দিনে ভাবতে হবে মাতৃভাষায় জ্ঞান অর্জন ব্যতিরেকে বিদেশি ভাষায় হাতেখড়ি কতটা যুক্তিযুক্ত। ধীরে ধীরে বড় হয়ে শিক্ষার্থী বিদেশি ভাষা শিখে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। এ স্বপ্ন পুরো জাতির সাথে আমরাও। জাতির অবিস্মরণীয় দিবস একুশ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা, বিজয় দিবসসহ অন্যান্য জাতীয় দিবস সম্পর্কে আজকের শিশু আগামী প্রজন্মকে যথাযথভাবে জানানো বা মর্যাদার সাথে পালন করা অতিব জরুরি।
অথচ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় দিবসগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় না। এর ফলে আগামী প্রজন্ম জাতির ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দায়সারাভাবে জাতীয় দিবসগুলো পালন হচ্ছে। যার ফলে শিশু শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবসে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, কত পূর্বে ঘটেছিল ও গুরুত্ব সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারছেনা। যেখানে জাতীয় দিবসে বিদ্যালয় পুরোদমে কার্যক্রম বা অনুষ্ঠান করার কথা সেখানে ছুটি দেখিয়ে শিক্ষকদের ছুটির দিনে জোর করে টেনে হেঁচড়ে উপস্থিত করিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলকে খুশি করার জন্য দায়সারাভাবে অনুষ্ঠান করা হয়। তালিকায় ছুটি থাকায় ক্ষেত্র বিশেষ শিক্ষার্থী উপস্থিতি নগন্য থাকে। কোথাও শিক্ষার্থী উপস্থিতি শূন্য থাকে। তালিকায় ছুটি দেখিয়ে শিক্ষক সমাজকে দিয়ে কাজ করানোর অনেকটা ‘‘দেখায় মুরগী খাওয়ায় ডাল” প্রবাদের মতো। জাতীয় দিবসগুলো অর্থবহ ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা প্রসঙ্গে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছিঃ
* জাতীয় দিবস সমূহকে ছুটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে কার্যদিন হিসাবে দেখানো।
* ৬টি জাতীয় দিবসের ছুটি গ্রীষ্মের ছুটির সাথে যোগ করে শ্র্রাস্তিবিনোদন ভাতা ৩ বৎসরে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেওয়া।
* শ্রেণিওয়ারী জাতীয় দিবসের পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা ।
* জাতীয় দিবসে ছুটি দেখিয়ে শিক্ষকদের কাজ করানো হলে বিধিমোতাবেক ভাতা দেওয়া।
* সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় দিবসগুলো বাধ্যতামূলকভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা।
* প্রাথমিকের ছুটির তালিকা প্রণয়নকারীদের দায়সারাভাবে জাতীয় দিবস পালনে সহযোগিতার জন্য বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ।
জাতীয় ঐতিহ্য, ইতিহাস জানার মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম সুনাগারিক হিসেবে গড়ে উঠবে। জাতীয় দিবস দায়সারাভাবে পালনে সকল চ্যালেঞ্জ দূর হবে। এ প্রত্যাশায়
লেখক: মো. সিদ্দিকুর রহমান, আহ্বায়ক প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম।