শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি, সমাজ, পরিবার বা ব্যক্তি সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে পারে না। তাছাড়া বর্তমান সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর। আর তাই পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ প্রয়োগ করছে।
কিন্ত শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত শিক্ষক সমাজ ও অভিভাবকমন্ডলী মোটা দাগে একই সমস্যা চিহ্নিত করছেন যে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী নয় বা স্বতঃস্ফুর্ত নয়।
বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটি প্রশ্ন বারবার চলে আসছে এমনটি কি হওয়া উচিৎ?
মানুষ জন্মগতভাবে কৌতুহলী, জ্ঞান পিপাসু। মানুষ অজানাকে জানতে চায়, অদেখাকে দেখতে চায়। এটা তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। জন্মের পর শিশু চোখ মেলে তার নিকট-পরিবেশকে দেখার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে সে বড় হতে থাকে। বিভিন্ন কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে তার সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়ে আনন্দ পায়, মজা পায়। মানুষ সাফল্য পিপাষু। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য সংগ্রাম করে। তাই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী নয়-এটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তার পরেও এমনটি ঘটছে কেন?
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, যে সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনায় স্বতঃস্ফুর্ত নয় তারা যে কৌতূহলী নয় এমন নয়। তারাও সমান কৌতূহলী। তাদের সামনে কোন মজার গল্প বা কোন ঘটনা তুলে ধরুন তাহলেই বুঝতে পারবেন তারা কতটুকু জানতে ইচ্ছুক। সাফল্যের জন্য তারাও ভীষণ উন্মুখ। কিন্তু তার পরেও তারা পড়াশোনায় উদাসীন কেন? আমি আমার প্রায় ষোল বছরের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় এর দু’টি কারণ দেখতে পেয়েছি।
যার প্রথমটি প্রধানত গ্রাম কেন্দ্রিক। গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, গরিব জনগণ তাদের ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণিগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়না। তারা মনে করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
অভিভাবকদের কারণেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হয়। শিক্ষকবৃন্দ যথাসাধ্য চেষ্টা করেও এ সমস্ত শিশুকে বেশি কিছু শেখাতে পারেনা। এ সমস্ত শিক্ষার্থী যখন পরবর্তি শ্রেণিতে উর্ত্তীণের উপযুক্ততা ছাড়াই উর্ত্তীণ হয় তখন তারা হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে।
যার ফলে তারা বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয় কামাই করতে থাকে। তারা প্রতিটি শ্রেণিতে অর্জন উপযোগী যোগ্যতাসমূহ অর্জন করতে পারে না। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় এ সমস্ত শিক্ষার্থী প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েও বাংলা পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার কারণে তারা বই পড়ে কোন তথ্য গ্রহণ করতে পারে না এবং কোন মজাও পায় না। তাই তারা পড়াশুনার প্রতি উদাসীন হয়ে পরে।
দ্বিতীয় কারণটি প্রধানত শহর কেন্দ্রিক।
শহরের অভিভাবকবৃন্দ অতিমাত্রায় আগ্রাসী। তাঁরা শিশুদের উপর অধিক প্রত্যাশা চাপিয়ে দেন এবং শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে রুদ্ধ করে দেন। দশ বছরের শিশুর ঘাড়ে যদি বিশ বছরের শিশুর উপযোগী বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হবে সন্দেহ নেই। ঠিক তেমনি দশ বছরের একজন শিশুর ঘারে যদি পনের বা বিশ বছরের শিশুর মানসিক বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে-সন্দেহ থাকার কথা নয়।
ইহা ছাড়াও শহরের শিক্ষা কার্যক্রম অতিমাত্রায় কোচিং ও টিউশনি নির্ভর। কোচিং সেন্টার গুলোতে যারা শিক্ষকতা করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা মূলত কোন ট্রেনিং প্রাপ্ত নন। তারা শিশুদের শ্রেণি ভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা প্রান্তিক যোগ্যতা সর্ম্পকে কোন ধারণাই রাখে না।
তারা কেবল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফলকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা শিশুদের দিয়ে উত্তরগুলো হুবহু মুখস্ত করিয়ে নেয়। শিশুদের উত্তর লেখার ক্ষেত্রে কোন স্বাধীনতা থাকে না। শিশুদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা গুলোকে অবমূল্যায়ন করা হয়। ধীরে ধীরে শিশুরা উৎপাদনশীলতা হারিয়ে ফেলে।
তাদের মস্তিস্কের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়ে ধূষর মরুভুমিতে পরিনত হয়। ধীরে ধীরে তারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এ সমস্ত শিক্ষার্থী বাবা মায়ের চাপে পড়ে এবং কোচিং ও হাউস টিউটরদের চাপে যেটুকু পড়াশোনা করে তার সমস্তটাই পরীক্ষার জন্য। এরা শেখার জন্য পড়েনা ভাল রেজাল্টের জন্য পড়ে। এসব শিশু বাবা মায়ের সাথে বাহ্যিক সুসর্ম্পক বজায় রাখে। আমি দেখেছি ঝঝঈ পাসের পর শিক্ষার্থীরা বাবা মায়েদের থেকে দুরে থাকার জন্য কতটা উদগ্র হয়ে ওঠে।
দেখতে বড় ভাল লাগে গ্রামের যে সমস্ত শিশু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা সমূহ অর্জন করে তারা পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে কতনা নিয়মিত। তারা কখনোই বিদ্যালয় কামাই করতে চায়না। অনেক দেখেছি বাবা মায়েরা কোন ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে মেহমান খেতে যেতে চায় কিন্তু সে বিদ্যালয় কামাই করতে চায়না। অবশেষে বাবা অথবা মা তাকে নিয়ে বিদ্যালয়ে এসে ছুটি নিয়ে যায়।
উপরিউলে¬খিত সমস্যা দুটির মধ্যে শহরের সমস্যাটাই আমার কাছে বেশি জটিল মনে হয়। মাস দুয়েক আগে একজন অত্যন্ত শিষ্ট, ভদ্র, নম্র ধনাঢ্য ব্যক্তি উনার সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে অনেক হতাশা ব্যক্ত করেন। তাঁর সন্তান শহরের একটি বিখ্যাত বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ঝঝঈ তে ভাল ফল করেছিল। ঐঝঈ পরীক্ষায় ও ভাল ফল করেছিল। কিন্তু সে কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়নি। তাই আমি যেন তাকে একটু সময় দিই। আমি সমব্যথী হয়ে উনার সন্তানকে সময় দিতে রাজি হই। গত দু’মাস যাবত আমি মাঝে মাঝে যাই। আমি দেখতে পাই বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে তার মৌলিক জ্ঞান নেই।
টেন্স, ভয়েস, কারক বিভক্তি, সমাস সে কোনটাই বুঝে না। তখন আমি তাকে বললাম, তুমি নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের কোন কোন বই পড়েছ?” সে কোন বই এর নাম বলতে পারল না। তারপর জানতে চাইলাম সে দৈনিক সংবাদপত্র পড়ে কিনা। সে নেতিবাচক উত্তর দিল।
সে আরও যা বলতে চাইল এ জাতীয় পড়া তাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ। তার কাছ থেকে আমি বাবা মায়ের প্রতি চরম বিরক্তি ফুটে উঠতে দেখেছি। আবার ভিন্ন রকম উদাহরণও আছে, যেমনঃ জেবা, সাদিয়া। এরা দু’জন ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ঝঝঈ পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছে। জেবা ১২২৭, নম্বর পেয়ে সম্ভবত ঠাকুরগাঁও জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে আর ১২১৬ নম্বর পেয়ে সাদিয়া তৃতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।
এদের দু’জনকে আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে কাছ থেকে চিনি। এরা প্রচুর পড়াশোনা করে। কিন্তু এরা কোন দিন কোন কোচিং সেন্টারে যায়নি। সাদিয়ার রিডিং টেবিলে হেরি পটার সিরিজের সমস্ত বই দেখে আমি তাজ্জব বনে গেছিলাম। আমি জানতে চাইলে সে বলে সে সবগুলো বই পড়ে ফেলেছে। জেবার বই পড়ার নেশাটা আরো বেশি। এদের দু’জনেরই ভাগ্য অনেক ভাল-তাদের বাবা মা অনেক ভাল বুঝেন।
এখন আমার একটি বিনীত প্রশ্ন “শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার মনোযোগী নয়” এজন্য কি শুধু শিক্ষার্থীরাই দায়ী। উত্তর বলার প্রয়োজন নেই।
লেখক : সহকারি শিক্ষক, পাহাড়ভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঠাকুরগাঁও সদর, ঠাকুরগাঁও