কলির কালে কত কী হবে ! আরো কত কী যে দেখে যেতে হবে আমাদের! সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে এসে ও আমরা যেন বার বার ফিরে যাই সে আদিমতায় । আমাদের কুরুচি মাঝে মাঝে বর্বরতাকে ও হার মানিয়ে চলে ।
‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’-আমাদের এ কালের কথিত বড় লোকেরা মাঝে মাঝে সেটি বেমালুম ভুলে যায় । তাদের অর্থ, বিত্ত,বৈভব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার মোহে অন্যদের মানুষ ভাবতে কখনো কখনো কষ্ট হয়।
আমাদের শিক্ষা , শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে নিয়ে বর্তমান সমাজে কত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবহেলা হয় , সে তো প্রায় সকলের জানা। মাত্র ক’বছর আগে ও এমন ছিল না ।
শিক্ষার প্রতি মানুষের ভালবাসা ও আগ্রহের এতটুকু ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি কোনদিন । শিক্ষার্থীদের মানুষ ভালবাসত আপন সন্তানের মত আর কতই না সমীহ করত তাদের । শিক্ষকদের সত্যিকারের ত্রাণকর্তা ভেবে তাদের সবার ওপরে মর্যাদা দিত । কিন্তু- আমাদের শিক্ষা , শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সে সুদিন আর নেই । এ জন্য দোষ দেই কাকে ? এর দায় কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে । শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও অবহেলা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের অপমানজনক পর্যায়ে অবনমিত করে রেখেছে । প্রায়শঃ দেখা যায়, রাজার ছেলের রাজকীয় সম্মান । চৌধুরী কিংবা জমিদারের ছেলে ও বাবার প্রায় কাছাকাছি যায় । কিন্তু , বাড়ির চাকরের সন্তানকে কেউই সম্মান দেখায় না কোনদিন ।
একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের মানস সন্তান । বর্তমান সমাজে শিক্ষকেরই সম্মান অনেকটা শুন্যের কোটায় । তাহলে, শিক্ষার্থী সম্মান কোথায় পাবে ? শিক্ষক যদি যথার্থ মান-সম্মান ও মর্যাদা পেতেন , তবে তার মানস সন্তান শিক্ষার্থীর পিঠে চড়ে হাঁটার দুঃসাহসটা কারো কোনদিন হতো না । এ দেশে শিক্ষকদের সম্মান সে কেবল মুখে মুখে । আমরা তাদের জাতি গঠনের কারিগর , জাতির স্থপতি-ইত্যাদি নানা বিশেষণে ভূষিত করি । এ দিয়ে তাদের পেট ভরে না যেমন, তেমনি তাদের পিঠে ও সয় না । কেবলি কথায় চিড়ে ভিজে না কোনদিন ।
আমাদের শিক্ষার প্রতি সরকার বলি আর কর্তৃপক্ষ যাই বলি না কেন, তাদের অবহেলা খালি চোখেই দেখার মত । একজন জেলা শিক্ষা অফিসারের পদমর্যাদা একজন ইউএনও’র নীচে । সে আমাদের কিছুতে বোধগম্য হয় না । একজন প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ একজন পুলিশের এএসআই’র ও সমান মর্যাদাটুকু পান না । একেবারে নিম্ন পর্যায়ের একজন আমলাও যে কোন স্তরের একজন শিক্ষককে তার সমকক্ষ ভাবতে নারাজ । এ হীনমন্যতার অবসান হওয়া চাই । শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান কেবল কথায় নয়, কাজে ও দেখাতে হবে । তাহলে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী-সকলেরই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে । জাতি হিসেবে ও আমাদের মর্যাদা বাড়বে।
গত ৩০ জানুয়ারি সোমবার চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার নীলকমল ওছমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে কথিত মানবসেতু তৈরি করে শিক্ষার্থীদের পিঠের ওপর ওঠে উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটওয়ারীর হেঁটে যাবার দৃশ্যটি কেবল শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের নয় , ই-মিডিয়ার সুবাদে সারা দেশের বিবেকবান সকল মানুষকেই মর্মাহত করেছে। এ হীন কাজটি মানব সভ্যতাকে ভূ-লুন্ঠিত করেছে । বিবেক স্তব্ধ হয়েছে ।
এ জাতীয় উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে শিক্ষা , শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চার আনার ও দাম নেই । এদের হাতে নিত্য লাঞ্চিত হন কত শিক্ষক । কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারটা বাজিয়ে চলেছেন এরা । স্কুল-কলেজের যে কোন অনুষ্ঠানে
এদের অতিথি না করলে সমস্যা আছে । কমিটিতে এদের না রাখলে উপায় নেই । এদের মনোতুষ্টির জন্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে মানবসেতু তৈরি করে তাদের পিঠের ওপর উপজেলা চেয়ারম্যানকে হাঁটানো হয়েছে কীনা – সে কেবল ঐ স্কুলের স্যারেরা বা বড় স্যার বলতে পারেন । যদি সে জন্য তারা তা করে থাকেন, তবে তাদের সে হীনমন্যতাকে ও ধিক্কার দিতেই হয় । শিক্ষকদের এরুপ হীন মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া চাই।
কষ্ট হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য , যারা না বুঝে নিজেদের দিয়ে সেতু তৈরি করতে সম্মত হয়েছে এবং এর ওপর চড়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে হেঁটে যেতে দিয়েছে । তাদের তো কোন দোষ খুঁজে পাইনে । আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত । ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে’-এ আমাদের ভুলে গেলে চলে কী করে ?
শিক্ষকরা আমাদের শিক্ষার চালিকা শক্তি । তাদের অবহেলা ও অমর্যাদায় ফেলে রেখে জাতি কোনদিন সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ।
হাইমচরের উপজেলা চেয়ারম্যানসহ এ ঘটনায় যারাই জড়িত , তাদের সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই। এহেন ঘটনার নিন্দা জানাবার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন । শিক্ষক সমাজকে কেবল মুখে নয়, বাস্তবেই মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসে গেছে। অন্যথায়, আবার যদি কেউ কোনদিন শিক্ষকদের দিয়ে মানবসেতু বানিয়ে তার ওপর দিয়ে হাঁটবার খায়েশ ব্যক্ত করে বসে! সে কোন অবান্তর কিছু নয়। ক্রমশঃ ঘটনার ধারাবাহিকতা আমাদের সে ইঙ্গিতই দেয় ।
[অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]