শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দুর্দিন - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দুর্দিন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
দেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী-এ দু’শ্রেণির ইদানিং বেশ দুর্দিন । শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের ভারে ও বোঝায় জর্জরিত । প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অনেক শিক্ষার্থী নিজের বই পুস্তকের ব্যাগ বহন করে স্কুলে নিয়ে যেতে ও আসতে হিমসিম খায় । তদুপরি তাদের পাঠ্যপুস্তক গুলো কঠিন । আমাদের সময় আমরা নবম-দশম শ্রেণিতে যা পড়েছি , আজকাল তা চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে হয় । আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েছি এমন অনেক বিষয়বস্তু এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিলেবাসভুক্ত ।
আগে আট-দশ বছর বয়স হলে বাবা-মা সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেন। এখন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির নির্ধারিত বয়স ৬+ বছর হলে ও অনেক বাবা-মা পাঁচ বছর বয়স হতে না হতে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন । কেউ কেউ মিথ্যে তথ্য দিয়ে জন্ম সনদে বয়স বাড়িয়ে নেন । ফলে আগেকার দিনে একটু বড় হয়ে যা পড়তে হয়েছে, আজকাল এরচে’ কম বয়সে তারচে’ বেশী পড়তে হয় । সে সময় সহজ ও সাবলীল ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হতো । আর আজকাল ? দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য । তিনি বলেন-”নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি আমি নিজেও অনেকটা বুঝি না”। তখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই পুস্তকের কাঠিন্যের বিষয়টি কতই না মূর্ত হয়ে ওঠে ।
আজকাল  প্রায় সবগুলো বিষয়ে এ কথাটি সমান ভাবে প্রযোজ্য । গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে তা আরো  অধিক খাঁটি সত্য কথা । সিলেবাস ও কারিকুলাম শিক্ষার্থীর বয়স ও রুচি অনুসারে তৈরি হবার কথা । কিন্তু, এখন কী তা সেভাবে হয় ? এমনিতে আজকাল মা-বাবার অতি উৎসাহের কারণে একটু হাঁটা-চলা ও কথা বলা শেখতে না শেখতে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় । একদিকে বয়স কম । অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ও পাঠের কাঠিন্য পড়াশুনার প্রতি দিনে দিনে তাদের কেবল নিরুৎসাহিত করে ।
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে দু’টো বড় মাপের পরীক্ষা । এমনিতে নানা কারণে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বিতর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ । প্রশ্নফাঁস ও যা তা খাতায় লিখে পরীক্ষায় পাস-এ দু’টো কারণে কেবল আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থা নয়, আমাদের শিক্ষা নিয়ে ও নানা কথা ওঠেছে । সর্ষে ভুত থাকলে তা দিয়ে ভুত সারানো কঠিন- সে তো অনেক পুরনো কথা । সুতরাং প্রশ্নফাঁস ও যা তা লিখে পাসের কারণে আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থাই যেখানে বিতর্কিত, সেখানে পরীক্ষা দ্বারা প্রকৃত  মেধা যাচাই করা সম্ভব নয়। অযথা কেবল সময় ক্ষেপন । খরচ ও অনেক । আগে এ দু’টো পরীক্ষা ছিল না । আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা কমিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা বাড়িয়ে দিলে এরচে’ লাভ হয়তো বেশী হতো । সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করে আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারলে বরং লাভ বেশী ।
মাঝে ক’বছর এক বছরে তিনটে পরীক্ষা ছিল । এখন মাধ্যমিকে দু’টো । প্রাথমিকে এখনো তিনটে। দু’টো করার চিন্তা-ভাবনা চলছে । প্রায় পুরোটা বছর একটা না একটা পরীক্ষা আছেই । এতে স্কুল-কলেজে কর্ম দিবস অনেক কমে যায় ।
আজকাল পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীর তেমন আগ্রহ থাকে না । বই পড়ার গরজ তাদের একেবারে যেন নেই ।  ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে ‘-পরিচিত পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে রচিত এ রকম কবিতা কিংবা পাঠের বড় অভাব আজকালের পাঠ্যপুস্তকে । নীতি-নৈতিকতা সম্বলিত শিক্ষা ও তেমন একটা নেই ।  হেঁসে খেলে শেখার ও সুযোগ সীমিত । বুঝে না বুঝে কেবল মুখস্ত করা ।  সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির কারণে আজকাল মুখস্ত করার প্রবণতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে । কিন্তু, তদুপরি সৃজনশীলের সুফলটা আমরা ঘরে তুলতে পারছি না । এখনো অনেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন । অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা তো শুরু থেকেই এ পদ্ধতির বিরোধি ।  শিক্ষায় জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার ছোঁয়া তেমন একটা নেই। এখনো ৯০% শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষা ধারায় পড়ালেখা করে । বিজ্ঞান,  কারিগরি ও আইসিটি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ যেমন কম, তেমনি এর সুযোগ ও সীমিত । পরিশেষে কোচিং ও নোট-গাইডের কারণে আজকাল কেবল আমাদের শিক্ষার্থীরা নয়, অভিভাবক পর্যন্ত নাকাল । শিক্ষা ব্যবস্থাই রসাতলে যাবার উপক্রম।
আমাদের শিক্ষকদের দুর্দিন ও দুর্দশা নিয়ে আর কত লিখব ?   সে তিনি যে স্তরের কিংবা যে ক্যাটাগরির শিক্ষক হউন না কেন। সমাজে শিক্ষকদের নিয়ে ইদানিং একটা নিগেটিভ ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠছে । একটা সময় শিক্ষকের মর্যাদা সবার ওপরে ছিল । কিন্তু, আজকাল বিপরীত অবস্থা ।
এক সময় শিক্ষকের কথা সকলে মান্যগন্য করেছে । কিন্ত, এখন শিক্ষক যেন সমাজের কাছে অনেকটা অপাংক্তেয় । কেন জানিনে, নিজের ওপর থেকে আজকাল শিক্ষক ও নিজের  আস্তা বিশ্বাষটুকু হারিয়ে ফেলছেন । এখন অনেক শিক্ষকই চান না বড় হয়ে তার সন্তান শিক্ষক হউক । মান-সম্মান ইজ্জত বজায় রেখে শিক্ষকতা করা আজকাল কঠিন হয়ে ওঠেছে । শিক্ষার্থীদের একান্ত প্রয়োজনে এক-আধটু শাসাবার অধিকার শিক্ষকের নেই । অকারণে নানা জায়গায় শিক্ষক লাঞ্চিত । ম্যানেজিং কমিটি মুগুর নিয়ে মাথার ওপর ।  শিক্ষকের একটু সুন্দর করে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করার সুযোগ সীমিত । বেসরকারি শিক্ষক হলে তো কথাই নেই । বৈষম্য ও বঞ্চনার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে একদিন শিক্ষকতার ইতি ঘটে । সে এক ভিন্ন রকম কষ্টের অভিজ্ঞতা !
বেসরকারি শিক্ষকের বদলি কিংবা পদোন্নতি কোনটাই নেই । একটু ভাল করে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করার নেই কোন গ্যারান্টি । নিত্য তার অভাব-অনটনের সাথে বুঝাপড়া করে চলা । বোনাস , বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি কোনটাই অন্যদের মত নয় । ইনক্রিমেন্ট নেই । জাতীয়তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বন্ধন বোশেখি ভাতাটি ও তাদের দেয়া হয়নি । সত্যি সেলুকাস ,  কী বিচিত্র  এ দেশ !
সরকারি ও বেসরকারি নামে শিক্ষকদের বিভাজন করে রাখা  সত্যি দুর্ভাগ্যজনক । দেশ এখন মধ্যম আয়ের কাছাকাছি । বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন মান দেখে তো এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া কঠিন । জাতিসংঘ ও বিশ্ব ব্যাংক এই একটা সুচকের কারণে হয়ত মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিতে চাইবে না । আর দেবেই বা কেন ? শিক্ষকদের জীবন মান বৃদ্ধি না পেলে কিসের মধ্যম আয়ের দেশ ? যে দেশে ইনক্রিমেন্ট ও বোশেখি ভাতার জন্য শিক্ষকদের মানববন্ধন, প্রতীকি অনশন, সভা-সমাবেশ করে ও কোন ফল হয় না-সে কেমন দেশ ?  মধ্যম আয়ের দেশ বলে দিনরাত যতই বাগাড়ম্বর করি না কেন, সে সবে কোন লাভ নেই ।
লেখক  :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট  দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034010410308838