শিক্ষার সর্বস্তরে চাই আইসিটি ও কর্মমুখী শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার সর্বস্তরে চাই আইসিটি ও কর্মমুখী শিক্ষা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমরা ‘যুগোপযোগি শিক্ষা’ ধারণাটির সাথে যতটুকু পরিচিত, ততটুকু সম্পৃক্ত নই । সব বিষয়ে সময়ের একটা বিশেষ দাবী থাকে । সে দাবী পূরণ করার নাম সময়ের সাথে খাপ খেয়ে এগিয়ে চলা । কিন্তু, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা সময়ের সাথে আজ পর্যন্ত কতটুকু খাপ খেয়ে এগিয়ে চলতে পেরেছি   – সে এখন ভেবে দেখার সময় ।

মানুষের জীবনে শিক্ষা এক নিয়ামক শক্তি । সারা পৃথিবীতে আজ অবধি যেটুকু অর্জন , সে কেবল শিক্ষার কারণে । শিক্ষার সাহায্যে মানুষের সভ্যতা আজ এতটুকু প্রসারিত হতে পেরেছে । পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যেটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে,  সে কেবল শিক্ষার বদৌলতে । জনৈক মনীষি বলেছেন, ‘শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার যা রাতারাতি বিশ্বকে বদলে দিতে পারে ‘।

সময়ের বিবর্তনে শিক্ষার স্বরুপ বা ধারা পরিবর্তন হয় । কৃষি নির্ভর সমাজ এবং শিল্পোন্নত সমাজে শিক্ষার ধরণ কিংবা স্বরুপ এক থাকে না । আবার উন্নত , উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের শিক্ষায় ও থাকে বিস্তর ব্যবধান ।

স্বাধীনতা অর্জনের বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর জাতি এবং উন্নয়নশীল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় উন্নীত হতে চলেছি । কৃষি নির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে আমাদের এখন শিল্প নির্ভরতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে । গার্মেন্টস শিল্পে বলতে গেলে আমরাই বিশ্ব সেরা। কিন্তু, সেভাবে আমাদের শিক্ষায় এতটুকু পরিবর্তন সুচিত হয় নাই।

স্বাধীনতা অর্জনের এতগুলো বছর পর ও আমাদের শিক্ষায় তেমন একটা মৌলিক পরিবর্তন নেই । কৃষি নির্ভর অর্থনীতির সময়কার শিক্ষা আর এখনকার সময়ের শিক্ষা প্রায় একই রকম ।

আমাদের শিক্ষায় নানা ধারা। প্রথমেই মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে একটু আলোকপাত করা যায় ।  দেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষায়  দু’টি ধারা । একটি কওমী ও অন্যটি সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা শিক্ষা । উভয় ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগি করার প্রয়াস একেবারে নেই  । কওমী মাদ্রাসাগুলেতে এখনো পুরনো দিনের উর্দু ভাষার কেতাবাদি পড়ানো হয় । পাকিস্তানী আমল প্রায় চার যুগ আগে গত হলে ও এখনো ওদের ভাষা কওমী মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলাম ও সিলেবাসে রয়ে গেছে । তাদের কারিকুলাম ও সিলেবাসে  জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার সংশ্লিষ্টতা একেবারে নেই বললে চলে । তাদের কেবল পরকালের কথা । ইহকালের উৎকর্ষতার কোন ইঙ্গিত নেই তাদের শিক্ষা ধারায় । ইহকাল বাদ দিয়ে পরকাল অর্জন করা  কঠিন – এ সত্যটি তাদের কারিকুলাম ও সিলেবাসে প্রতিষ্ঠা করতে হবে । ‘পৃথিবী পরকালের শস্যক্ষেত্র’-সে অমর কথাটির যথার্থতা কত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ।

সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে ও যুগোপযোগি কারিকুলাম নেই। সারা দেশে একটি মাত্র বোর্ড তাদের । পরিদর্শন,  তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতা জোরদার না থাকায় দায়সারা ভাবে চলে এ সকল মাদ্রাসা । এ করে মাদ্রাসা শিক্ষিত বেশীর ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন শেষে বেকার জীবন বরণ করে । তাদের শিক্ষায় কর্মমুখীতা নেই বললে চলে । মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে কারো যেন দায় নেই ।

এবার আমাদের প্রচলিত ধারার আধুনিক শিক্ষার প্রতি আলোকপাত করা যাক । তাতে ও জীবন দক্ষতা ভিত্তিক বা কর্মমুখি শিক্ষা কতটুকু সম্পৃক্ত করা গেছে?  এ ধারায় ও দিনে দিনে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দেশের উন্নয়নকে সংকটে ফেলে রেখেছে ।

সাধারণ শিক্ষা এখনো অনেকটা গতানুগতিক ধারায় চলছে । বিজ্ঞানের যুগে ও বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর ততটা গুরুত্বারোপ নেই । কর্মমুখি কিংবা জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা কেবল পিছু পিছু হেঁটেছে আমাদের । আমরা এ সবে তেমন ফিরে ও তাকাইনি । এখন প্রযুক্তির যুগ । বিজ্ঞানের যুগ পেরিয়ে বিশ্ব এখন অবাধ তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে ।

বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার । কিন্তু, আমরা এখনো সেই গতানুগতিক শিক্ষার বেড়াজালে আটকে রয়েছি ।

আমাদের শিক্ষায় সম্প্রতি ‘আইসিটি’ এবং ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ নামে পৃথক দু’টি বিষয় চালু করা হয়েছে । কিন্তু, সে নামে মাত্র । এভাবে তো কাজের কাজ কিছু হয় না । ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’র মতো বিষয়ের কোন শিক্ষক নেই । ‘আইসিটি’র মতো এ সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনেক শিক্ষক বিনা বেতনে কাজ করেন। এদিকে ‘আইসিটি’ এবং ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ বিষয় দু’টি সাধারণ শিক্ষার সাথেই পঠিত হয় । ফলে বিষয় দু’টি অন্য আর পাঁচটি বিষয় থেকে পৃথক গুরুত্ব বহন করতে পারে না । কিন্তু বর্তমান সময়ে এ দু’টো বিষয়কে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট ও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত ।

আমাদের যত্রতত্র এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠছে। সবই সাধারণ ধারার । কারিগরি স্কুল , কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ক’টি আছে ?

সারা দেশে একটিমাত্র কারিগরি শিক্ষাবোর্ড । অথচ, সাধারণ শিক্ষায় এতগুলো বোর্ড !

দেশে কারিগরি হাতে গোনা যে ক’টি বেসরকারি স্কুল- কলেজ আছে , সেখানে ও অনেক শিক্ষকের বেতন নেই । ১৩.১১.১১  তারিখের বাজে এক প্রজ্ঞাপন এখানে ও অনেকের কপাল পুড়ে রেখেছে ।

আমাদের এখন সময় হয়েছে , গতানুগতিক শিক্ষা পরিহার করে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো । সাধারণ শিক্ষার পেছনে এত কোটি টাকা খরছ না করে শিক্ষা খাতের সিংহ ভাগ অর্থ আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা উচিত । দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে কারিগরি ইন্সটিটিউট, প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি কলেজ এবং অন্ততঃ প্রতিটি বিভাগীয় সদরে একটি করে হলেও আইসিটি ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য । প্রয়োজনে প্রতিটি স্কুল-কলেজে আইসিটি ও কারিগরি শাখা সংযুক্ত করে দেয়া যেতে পারে । আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা সকলের জন্য বাধ্যতামুলক করা যায় কীনা-সে আমরা ভেবে দেখতে পারি।

বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আইসিটি ও কারিগরি বিষয়ে লেগে থাকতে চায় । আমরা কেন চাইবো না-তারা তাই নিয়ে লেগে থাকুক । সাধারণ শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখতে অনেকটা ব্যর্থ । বই পুস্তকে তাদের

অনেকের মন বসেনা । জন্মেই তারা টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি দেখেছে । আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষায় তাদের তো আগ্রহ বেশী হবেই । তারা নিজেরা হাতে-কলমে কাজ করে করে শেখতে চায় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ সাধারণ শিক্ষা সংকোচিত করে কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল বলে তারা এখন বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পোন্নত দেশ । আমাদের ও তাই করা হলে আগামী এক দশক সময়ে অনেককে পিছে ফেলে অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় সোনার স্বদেশ ।

[অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004188060760498