শিক্ষা পেশায় বিভক্তি : অশনি সংকেত - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা পেশায় বিভক্তি : অশনি সংকেত

অমিত রায় চৌধুরী |

মানবমনকে অজ্ঞানতার কৃষ্ণগহ্বর থেকে উন্মুক্ত করে যুক্তিশৃঙ্খলায় পরিশীলিত করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। যতদূর জানা যায় এ জনপদে শিক্ষা ভাবনার সূত্রপাত হয় তিন হাজার বছর পূর্বে বৈদিক যুগে। বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর পরস্পর বিপ্রতীপ সাংস্কৃতিক, ধর্মাশ্রয়ী ও রাজনৈতিক দর্শনের অনিবার্য প্রভাবে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপে শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একটি ন্যায়ভিত্তিক ও আধুনিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন।

জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রগতিশীল স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বাঙালির গড়ে ওঠার স্বপ্নকে শুধু তছনছ করেছে তা নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে দেশের শিক্ষা খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে জায়গা করে নেয় বহুধা বিভক্ত শিক্ষা কাঠামো- প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। ধর্মভিত্তিক, ভাষা (মাধ্যম) নির্ভর, এনজিও পরিচালিত, বেসরকারি, আধা-সরকারি, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি-এমনকি নাগরিকের মানস গঠনে বিভাজিত পথনকশা মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত বৈষম্যহীন শিক্ষার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

ভোগবাদী ভাবনায় আচ্ছন্ন সমাজ মানস নতুন বিভক্তির ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। জাতি গঠনে অন্যতম অনুঘটক শিক্ষা পেশা নানামাত্রিক বিভেদে ক্লেদক্লিস্ট হয়ে পড়ে। বাজার অর্থনীতির অনিয়ন্ত্রিত বিকাশের পথ ধরে ব্যক্তির বিত্তবৈভব গঠনের দৌড়ে নৈতিকতা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে।

দুর্নীতির বাজার যখন উন্মুক্ত, রুগ্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিপর্যস্ত- লক্ষ্য করেছি প্রায় ২ যুগ ধরে চলেছে শিক্ষাঙ্গনে অপরাধ ও সন্ত্রাসের আগ্রাসী আস্ফালন, অন্যদিকে পরীক্ষায় অবাধ গণটুকাটুকি। কী বিপজ্জনক প্রক্রিয়া-ভবিষ্যৎ নির্মাণের সূতিকাগার পরিণত হলো যুগলালিত শিক্ষা, আদর্শ, নীতি নির্মূলের কুরুক্ষেত্র।

এমনই এক ধোঁয়াশার মধ্যে বেড়ে ওঠা কোন নাগরিক একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর দায়িত্ব কী হবে-তা নির্ণয়ে বিভ্রান্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক। ১৮৫৮ সালের ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উপনিবেশিক প্রভুত্ব, আধিপত্য ও শাসনের প্রতীক হিসেবে ১৯৪৭ সাল অবধি বলবৎ ছিল; যা স্বাধীন ভারতবর্ষে আইসিএস অথবা পাকিস্তানে সিএসপির কার্যপরিধি ও দর্শনের সমর্থক নয়। আর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্যের আকাঙ্ক্ষায় প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণ নিছক জনগণের সেবক হবেন- এমনটিই প্রত্যাশিত, কাম্য।

কিন্তু সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অব্যাহত অনুশীলনের অভাবে ও কায়েমি স্বার্থ গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যাওয়ায় উপনিবেশিক ধাঁচে সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির বিকাশ ঘটতে থাকে। দুর্নীতির দুর্নিবার আকর্ষণে জাতির মেধাবী সন্তানদের এক অংশ পথভ্রষ্ট হন। অনস্বীকার্য যে, রাজনীতিতে একইভাবে কর্তৃত্ব পরায়নতা, সুবিধাবাদিতা, আপসকামিতার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ সমাজ কাঠামোর বুননকে বদলে ফেলতে থাকে। চরম দুর্ভাগ্যজনক এই যে, একদা নিষ্ঠা, আদর্শ, ত্যাগ ও সততার রোল মডেল শিক্ষকও বৈষয়িক সমৃদ্ধি, আভিজাত্য ও কৌলিন্যের প্রতীক সরকারি কর্মচারী হওয়ার অলীক ও অদম্য হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেনি।

একদিকে পেশায় পেশায় মনোস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। নির্বাহী, আইন কিংবা বিচার বিভাগ-রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভের কোনটিই এই সংকট থেকে রেহাই পায়নি। শিক্ষাও পিছিয়ে নেই মর্যাদার প্রশ্নে প্রাথমিক হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, বিরোধ নিষ্পত্তিতে অনেক জটিল চড়াই উৎরাই পার করতে হয়েছে। কিন্ত শিক্ষা পেশার অন্তবিরোধ শিক্ষার্থী তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোন সুখকর বার্তা বয়ে আনেনি।

উপজেলা পর্যায়ে স্কুল, কলেজ সরকারিকরণের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ফলে সরকারি-বেসরকারি, ক্যাডার-নন ক্যাডার সংক্রান্তে সৃষ্ট বিতর্ক পেশার অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ বলয়ে সাম্প্রতিকতম সংযোজন। পদোন্নতি, পদায়ন কিংবা প্রেষণে অংশীদারিত্বের পরিধি বাড়তে পারে- এমন বৈষয়িক অপ্রাপ্তির আশঙ্কা থেকেই এই বিরোধের সূত্রপাত। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে তাহলে যোগ্যতার মাপকাঠী কী। শুধুই জাগতিক সুবিধা অর্জন না অন্য কিছু।

প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, দেশের ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ বেসরকারি শিক্ষক প্রায় একটি অবিমিশ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাসেবা প্রদান করে আসছে। ৩২৯টি সরকারি কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষক এই বিশাল কর্মযজ্ঞে জনমিতির বিপরীতে নিতান্ত অপ্রতুল অবদান রাখছে। যারা আজ রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, সর্বোচ্চ বিদ্যপীঠের শিক্ষক, আমলা, বিচারক- এদের মধ্যে নিরষ্কুশ প্রাধান্য তাদের যারা এই তথাকথিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন।

আবার, কারিকুলাম প্রণয়ন, প্রশ্ন প্রণয়ন, উত্তরপত্র পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ, পরিদর্শন- কোন ক্ষেত্রেই এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে বাদ রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা সম্ভব নয় বা সরকারি, বেসরকারি ভেদে কর্মমূল্যায়নের মানে তারতম্য হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষা পেশায় যে স্খলনের অভিযোগ উঠেছে, তা যে ইস্যুকে কেন্দ্র করেই হোক না কেন কোন ক্ষেত্রেই এই দুই ধারার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য দেখা যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে (বর্তমানে যা কার্যকর নাই)।

মনে রাখতে হবে সে প্রক্রিয়াতে কোনভাবেই সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ ন্যায্য বা অন্যায্য- কোন শিক্ষক নিযুক্তির দায় এড়াতে পারেন না। নির্মোহ বিবেচনায় বরং অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানের নিম্নগামিতা দৃষ্টিকটু হারে বাড়ছে। ভাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীরা কোচিং ক্লাসেই পড়াশুনা করে। ক্যাম্পাসগুলো প্রায়ই ফাঁকা থাকে- এটিই অপ্রিয় বাস্তবতা। শিক্ষকদের সপ্তাহে দুই-তিন দিন হাজিরা দেওয়ার অভিযোগ তো আছেই। শুধু তাই নয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি হওয়ার পর খ্যাতি বা সেবার মানে অবনমন ঘটেছে এ নজির ভূরি ভূরি। অন্যদিকে ভালো বেসরকারি কলেজ এখনও তার মান বজায় রেখে চলেছে-এটাও অজানা নয়।

আর মফস্বলের ব্যাপক সংখ্যক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অন্তত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মাঝারি অথবা দুর্বল শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে ভালো ফল করানোর অসম প্রতিযোগিতায় তীব্র পরিশ্রম করে যাচ্ছে-এ কথা সত্য। সম্প্রতি সরকার জিপিআরএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষকের হাজিরা তদারকি করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সুধীজন স্বাগত জানালেও সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ খুশি হতে পেরেছেন বলে জানা যায় না।

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারিকরণ বা শিক্ষকদের ক্যাডার বানানোর প্রথা কালসিদ্ধ নয়, সাম্প্রতিক। দেশে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকবে। রাষ্ট্র যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা করবে। কিন্তু শিক্ষককে কেন অফিসার হতে হবে- বুঝি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিব্রিটি শিক্ষকগণকে তো ক্যাডার হতে হয়নি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত থাকবে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে। সৃজনশীল গবেষণা হবে। যুক্তি, ন্যায়বোধ, মানবিকতা, সংবেদনশীলতা, পরার্থপরতা, ঔদার্য, সহনশীলতা, জীবন ও জগৎ নিয়ে অন্তহীন ভাবনা শিক্ষকের বুদ্ধিবৃত্তিক চারণভূমি হবে। শুধু শ্রেণীকক্ষেই নয়, সমাজের আইকনও তিনি। জাতির বিবেক। প্রশাসনিক ক্যাডারের কাঠামোবদ্ধ পরিসরে তার বৌদ্ধিক বিচরণ সীমিত হতে পারে না।

অবশেষে অকপটে বলতে চাই- বেসরকারি শিক্ষকদের দুর্বল জ্ঞানে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে প্রবলতর ক্যাডার বা প্রতাপশালী রাজনীতিককে সবল বিবেচনায় তার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের অঢেল প্রদর্শনীতে একটি অসংস্কৃত আত্মশ্লাঘা থাকতে পারে- শিক্ষক হিসেবে মিথ্যা কৌলিন্যের এই ভূষণ মহান পেশার উচ্চকিত মর্যাদার জায়গাটি উজ্জ্বল করে না বরং ক্রমাগত ক্লেদাক্ত, সংকীর্ণ করে ফেলে। বরং মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে একটি গণমুখী, বিজ্ঞান মনষ্ক, বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সকল বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পথে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে ত্রুটি, পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের মতো অন্তরায়সমূহ দূরীকরণে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

সকল ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে উঠে শিক্ষকের চিরায়ত আত্মনিবেদনের জায়গা থেকে বিশাল তারুণ্যকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে, শিক্ষার্থীকে চিন্তায়, চেতনায়, মননে ঋদ্ধ করতে যা কিছু করণীয় তার সবটুকু উজাড় করতে হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণে। আর অচিরেই আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সাম্যের ভিত্তিতে মানসম্মত শিক্ষাকে সর্বজনীন করা হবে- সকল দেশপ্রেমিক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এটাই প্রত্যাশা।

 

[অমিত রায় চৌধুরী : অধ্যক্ষ, ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়]

সূত্র: দৈনিক সংবাদ

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0083270072937012