বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবারগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি খরচ করছে স্কুলের পড়াশোনার জন্য। স্কুলে যাচ্ছেও অনেক বেশি ছেলেমেয়ে। কিন্তু কি শিখছে তারা? এমন প্রশ্ন যদি করা হয়, তাহলে অনেক রকম বিতর্ক শুরু হবে। শুধু এটুকুতেই যদি থাকতে চাই যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন, তাহলে বোধ করি একটু আলোচনা করতেই হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন পর্যায়ের পাঠ্য বইয়ের যেসব বিষয় আমাদের সামনে সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসছে, তাতে সত্যি ভীত, সন্ত্রস্ত, বিচলিত হতে হয়। Heart আর Hurt এর পার্থক্য করতে পারেন না যারা তারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বই লিখছেন শিশুদের জন্য। তাদেরই মাধ্যমে শিশুদের মননে মৌলবাদ, সংকীর্ণতা ঢুকছে আর আমাদের সদাশয় কর্তৃপক্ষ তা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। বছরের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেয়া একটি বড় সাফল্য কিন্তু ভুলে ভরা বই কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার দর্শনে ভরা বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিয়ে কি অর্জন করছি আমরা?
শিক্ষায় রা্ষ্ট্রীয় এবং পারিবারিক বিনিয়োগ বেড়েছে। অনেক স্কুল তৈরি হচ্ছে, অনেক শিক্ষক নিয়োগ চলছে। নতুন বছরে সরকারের দেয়া নতুন বই, বাড়তি শ্রেণিকক্ষ, শৌচাগার, মিড ডে মিলসহ কত কি আয়োজন। অথচ ছেলেমেয়েরা শিখছে অতি সামান্য। প্রাথমিক স্কুল থেকে যারা বেরোচ্ছে, তাদের একটি বড় অংশই লেখা, পড়া, অঙ্ক কষার গোড়ার কাজগুলো পারছে না। উচ্চশ্রেণিতেও একই অবস্থা।
না শেখার সংকট আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সংকট এই যে অভিভাবকরা এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননা। সবাই শুধু ভাল ফল চায়। জিপিএ-৫ নামের এক রোগে পুরো জাতি এখন উন্মত্ত। শিক্ষকদের একটা বড় অংশই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অংক, ইংরেজি আর বিজ্ঞান বোঝাতে পারছেন না। এ চিত্র কেবল গ্রামের স্কুলের নয়, নামীদামি স্কুলের শিক্ষকরাও এমনটাই। তারাই কিন্তু বিশেষজ্ঞ হিসেবে বই প্রণয়ন কমিটিতে থেকে Hurt এর স্থলে Heart লিখছেন।
সিলেবাস নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু আমাদের ক্লাশরুমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে পারছেন না কেন, সেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। আমাদের স্কুলে গোটা পড়াশোনাটাই ভাল ফলাফল মুখি, শিক্ষামুখি নয়। আমাদের সিলেবাস ভুলে ভরা, অন্ধকারের শক্তির চাপে প্রতিক্রিয়াশীলতায় আচ্ছন্ন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যতটা পারা যায় শিখিয়ে দিতে হবে, এই তাগিদ থেকে সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, সকল সিলেবাসই শুধু বিষয় দিয়ে ঠাসা। কোন ক্লাশে কোন বিষয় কতটুকু পড়ানো হবে তার কোন বিজ্ঞান সম্মত ভাবনা কখনো ভাবা হয়নি।
উন্নত দেশে জোর দেয়া হয় পড়ুয়ার লেখার ক্ষমতা, নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতার উপরে। হোম ওয়ার্কে শিশুর স্বাধীনতা থাকছে কোন একটা বিষয় বুঝে নিজের মতো করে প্রকাশের। কিন্তু এখানকার বহু স্কুলে ক্লাসে শিক্ষকরা যা পড়ান তা-ই লিখতে হবে। ফলে আমরা যে পরীক্ষা নিয়ে থাকি বাচ্চাদের তা আসলে শেষ পর্যন্ত বাধ্যতার পরীক্ষা, দক্ষতার পরীক্ষা নয়।
আমাকে এক ছাত্র বলেছে, ক্লাশে তার শিক্ষকের দেয়া তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে বলা হয়েছে ‘তুই কি টিচার?’ এমন করে প্রশ্ন করার ইচ্ছেটাই শুধু দমিয়ে দেয়া হয় না স্কুলে, সেই সব শিক্ষার্থীর প্রতি প্রতিনিয়ত নেতিবাচক দৃষ্টি রেখে থাকেন শিক্ষকরা। একারণেই রাতদিন পড়াশোনা করেও পড়ুয়াদের দক্ষতা তৈরি হয় না।
সিলেবাস নিয়ে ভাববো, কিন্তু কী করলে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে আরো ভাল শিখবে তা নিয়েও চিন্তা দরকার। আদালত সম্প্রতি স্কুলের বাচ্চাদের ব্যাগের ওজন নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের স্কুল মানেতো একের পর এক ক্লাশ। বাড়ি ফিরলেও মা-বাবার শাসন, কিংবা কোচিং-এর চাপ। ওদের ‘ফ্রি টাইম’ কোথায়? আমাদের ভাবনার মধ্যেই নেই যে, কম পড়ালেই শিশুরা বেশি শেখে।
কী করলে শিক্ষার্থীরা আরো ভাল শিখবে সেই চিন্তা থেকে পড়ানো হয় না। বরং ‘পড়ার চাপ’ বাড়ানোই ভাল স্কুল, ভাল শিক্ষক আর ভাল বাবা-মা’র বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাল ফল করারাই উচ্চতর শিক্ষায় বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তেমন ভাল করতে পারছে না। শুধু সিলেবাস নয়, শেখানোর জন্য শিক্ষকের বাড়তি উদ্যোগ আজ বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সেরকম শিক্ষক কোথায় আজ?
বড় পরিবর্তনও যে আসেনি, তা তো নয়। স্বাধীনতার সময়ে স্বাক্ষরতার যে হার ছিল আজ তা অনেক বেড়েছে। প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। কিন্তু জানার জায়গায় আমাদের বেহাল দশা। শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সাহস জোগায়, উদার হতে শেখায়। শিক্ষা থেকেই প্রত্যয় জেগে উঠে দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করার। আর সেটা করতে গেলে জানতে হবে, দক্ষ হয়ে উঠতে হবে, অন্ধকারের পথ ছেড়ে উদারতার পথে চলতে শেখাতে হবে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা একটি সামাজিক আন্দোলন যে পথ ধরেই আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসছে। তাই বই চাই এমন বই, হুমায়ুন আজাদের ভাষায় যে ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে’। এমন বই নয় যে বই কেবল ভয় দেখায় শিশু মনে, যে বই তাদের অন্ধ করে। ভাল বই, ভাল পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে ভাবুন শিক্ষামন্ত্রী, তাহলে সমাজ শুধু নয়, আপনারাও আলো দেখতে পাবেন।
পাবলিক পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রতিবছর যে কাণ্ড হয়, সেকথা মাথায় রেখে বলছি শিক্ষার্থীর মূল্যায়ণ দরকার, কিন্তু তার পদ্ধতিটি ভাবার সময় এসেছে। প্রতিযোগিতার লক্ষ্য পূরণের দায়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন ব্যাহত না হয়। শুধু পরীক্ষা-ক্লিষ্ট জীবন শিশুদের প্রতি বিরাট অবিচার।