বর্তমান সরকারের নির্দেশে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সময়মতো বই পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। আগের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে সম্প্র্রসারণ ঘটছে। তবে ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞানচর্চা করতে চাচ্ছে না। আমি গবেষণা করে দেখেছি, অন্তত ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বিজ্ঞান শিক্ষা করলে পরে যে কোনো বিষয়ে (সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা ব্যবসায় প্রশাসন) পড়লে ভালো হয়। অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কারিগরি বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করতে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি আমাদের দেশে কেন মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে, যেখানে বিশ্ব গ্রহণ করে থাকে গড়ে ৪৩ শতাংশ। আমাদের দেশের হযবরল কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা এবং ‘শিক্ষক’ নামধারী কিছু অবিবেচক এজন্য দায়ী। এছাড়া সমাজে এখনও সম্মানিত অভিভাবকরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সম্মানজনক হিসেবে দেখছেন না। এ যুগেও অভিভাবকরা মূলত সিদ্ধান্ত নেন বড় হয়ে তার সন্তানরা কী পড়বে।
সম্মিলিত নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমাকে প্রাথমিক বিজ্ঞান বইয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বইগুলো একটু পর্যালোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথমে বেশ কয়েকদিন ধরে তৃতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞান বইটি দেখলাম। ধাতস্থ হতে বেশ কয়েকদিন লাগল। তারপর পরিচিত সাংবাদিক, শিক্ষক ও ব্যাংকার তিনজন অভিভাবক, যাদের সন্তান তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তাদের সঙ্গে আলাপ হল। সাংবাদিক ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনি তার কন্যাকে এজন্য ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছেন। শিক্ষক মহোদয় বললেন, তার স্ত্রী যেহেতু বিজ্ঞানের অধ্যাপক, সেহেতু তিনি নিজেই সমাধান করে দিচ্ছেন। এরপর পরিচিত ব্যাংকারের সঙ্গে আলাপ করলাম। প্রশ্নটি করতেই প্রথমে বললেন, ‘রাবিশ’! আমি মনে মনে ভাবলাম ভদ্রলোকের আবার কী হল? তিনি বিরস বদনে বললেন, স্কুলে তো কিছুই শেখায় না, সারাদিন পর ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি গিয়ে মেয়েকে পড়ানোর ধৈর্য থাকে না। বরং তার স্ত্রীই কন্যাকে নিয়ে বিভিন্ন কোচিংয়ে বাধ্য হয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন। তাহলে স্কুলে পাঠান কেন? এবার তিনি বললেন, সমাজে আমার একটা স্ট্যাটাস আছে না? ওই ‘নামি’ স্কুলে যদি আমার মেয়ে না পড়তে পারত তাহলে আমার ইজ্জত কোথায় থাকত? এবার আমার একটু ঘাবড়ে যাওয়ার পালা। এত নামি স্কুল, সেখানে শিক্ষকরা পড়ান না! বিষয়টি ভেরিফাই করতে আমার এক পুরনো সহকর্মী, যিনি একসময় ওই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন এবং তার দু’কন্যাকে পড়াচ্ছেন- তার সঙ্গে আলাপ করলাম। বললেন, স্যার দুঃখের কথা কী বলব, আমি নিজেও একজন শিক্ষক এবং ওই স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। সেখানে এখন আমার মেয়েদের পড়াশোনা হয় না। ‘আমি আর মেয়েদের বাবা’ পালা করে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার পর কোচিংয়ে দিই। বাণিজ্যের টিচার তো! তাই বিজ্ঞান নিজেও পারিনি, বাবুদের বাবাও পারে না; হায় এ দুঃখের অবস্থা কীভাবে লাঘব হবে?
এখন তৃতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। অনাবশ্যকভাবে ‘প্রসঙ্গ কথা’ দেয়া আছে। বইয়ের রচনা ও সম্পাদনায় যারা আছেন, তারা সুপরিচিত। তবে বোধহয় মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি পরিমার্জনে যারা আছেন, তারাও খারাপ নন। যখন বুদ্ধিমানের বুদ্ধিবিভ্রাট ঘটে কিংবা অন্য কোনো কারণে বুদ্ধি লোপ পায়, তখন বোধহয় এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আছে ‘আমাদের পরিবেশ’। এখানে পরিবেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে মাত্র দু’লাইন। তৃতীয় লাইনে ‘পরিবেশ’ শব্দটি লাল অক্ষরে দেয়া। বোধহয় বোঝাতে চেয়েছেন, লাল হচ্ছে ভয়ংকর। এরপরই প্রশ্ন ও কাজ। কাজ আবার রয়েছে ৫টি। শ্রেণীকক্ষ, মাঠ ও বাগানের জিনিস। এরপর দেয়া হয়েছে সারসংক্ষেপ ছবি। ছবি বোঝার কোনো উপায় নেই। পরেই আবার প্রশ্ন। এরপর তিনটি কাজ। সর্বশেষটি মানুষের তৈরি আর তা দেখে শিশুদের বিরক্তি লাগবে, নান্দনিক সুষমা হারিয়ে গেছে। তারপর আবার সারসংক্ষেপ সাড়ে চার লাইন। এর মধ্যে দশটি শব্দ আবার লাল। তারপর প্রাকৃতিক পরিবেশ, অস্পষ্ট ছবি আর কঠিন করে সহজকে প্রকাশ করার ভঙ্গিমা। এরপর মানুষের তৈরি পরিবেশ এবং সঙ্গে ছবি, কোনোটি শিশুদের উপযুক্ত নয়। পৃষ্ঠা ৫-এ রয়েছে অনুশীলনী। ছাত্রছাত্রীদের বিরক্তির বোঝা বাড়ানোর এটি আরেকটি ধাপ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে জীব ও জড়। মাত্র একলাইন। তার মধ্যে আবার লাল রঙে লেখা জীব ও জড়। তারপরই আগের মতো প্রশ্ন। এরপর চারটি কাজ, পৃষ্ঠা ৭-এ জীব সম্পর্কে ২.৫ লাইন, তারপর তিনটি ছবি। এ ছবিগুলোও অর্থহীন। যেমন জীব বৃদ্ধি পায়। একটি ছোট শিশু- তীর দিয়ে ছোট বালক-যুবক। আসলে এটি বুঝতে আমার মতো মানুষের অনেকক্ষণ লেগেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছি, হায়রে অভাগা- ঘটে তোর বুদ্ধি নেই! জীবনে পানি প্রয়োজন ছবিটিতে গরুর ছবি অস্পষ্ট। জড়-এ অনেক কষ্ট করেও চতুর্থ ছবিটি বুঝতে পারিনি। একবার সন্দেহ হয় বাস্তব, পরে আবার মনে হয় মোটা বই। এরপর আবার প্রশ্ন- এবার তিনটি কাজ। এদিকে ছোট করে বইয়ের বোঝা কাঁধে শিশুরা রয়েছে। পৃষ্ঠা ৮-এ রয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী। গরু বা ঘোড়া কোনোটিই বোঝার উপায় নেই। পাখিটি কোন ধরনের তা বুঝতে পারলাম না। তার মধ্যে আবার রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারপর আর তার কান লিখে শোনা, চোখ লিখে দেখা, মুখ লিখে স্বাদ নেয়া এবং নাক লিখে ঘ্রাণ নেয়া, নিচে লেখা প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ। আসলে কী বোঝানো হচ্ছেন, তা লেখক মহোদয়রাই কেবল জানেন। এত ছবির কোনো দরকার ছিল না।
তৃতীয় শ্রেণীতে উদ্ভিদের কাণ্ড, শাখা, মূল শেখানোর চেষ্টা- কাণ্ডজ্ঞানহীন নামি মানুষ, অধ্যাপকের কাণ্ড বটে! আবার আলোচনায় রয়েছে প্রশ্ন, তার সঙ্গে করণীয়। পৃষ্ঠা ৯-এ রয়েছে উদ্ভিদ, তারপর চিত্রমালা, এরপর একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন- যার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। যেমন ছত্রাক। আবার রয়েছে মস নামক উদ্ভিদ। এদের আকার, কাণ্ড শক্ত না নরম, ফুল ফোটে কিনা। ছাত্রছাত্রী তো দূরের কথা, শিক্ষক-শিক্ষিকা জানেন কিনা সেটিই প্রশ্ন। পৃষ্ঠা ১০-এ রয়েছে অপুষ্পক ও সপুষ্পক উদ্ভিদ। মনে হয় না এতকিছু ষষ্ঠ শ্রেণীর আগে পড়েছি। রয়েছে বৃক্ষ, গুল্ম শ্রেণী, বিরুৎ শ্রেণীর উদ্ভিদ। হায়রে ৯ বছরের বাচ্চা- তোরা কত জ্ঞানী শিক্ষকের হাতে পড়েছিস? বদহজম না হয়ে যাবে কোথায়? পৃষ্ঠা ১১-তে রয়েছে বিভিন্ন রকমের প্রাণী। আবার চিরাচরিত প্রশ্ন। এ যেন কংস বধের মতো শিশুদের স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত করা। বই লিখে মানসিকভাবে অত্যাচার করা। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শ্রেণীবিন্যাস পৃষ্ঠা ১২-তে রয়েছে। পৃষ্ঠা ১৩-তে আবার সেই ধরনের প্রশ্নমালা। পৃষ্ঠা ১৪-তে ঘাস থেকে শুরু করে খায় এমন প্রাণীর একটি চক্রের চিত্র আঁকা হয়েছে। আমি মনে মনে বলি, হায়রে এত কঠিন বই! আমাদের সময়ে এটা থাকলে নির্ঘাত ফেল করতাম। এরপর পৃষ্ঠা ১৫-তে গেলাম। আরে, দেখি পৃষ্ঠাজুড়ে প্রশ্ন আর প্রশ্ন। এর মাজেজাটা কী? প্রশ্ন করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে। তিনি তো আমার প্রশ্ন শুনে হেসে আর মুখ বন্ধ করতে চান না। বললেন, আরে বাবা যত কঠিন হবে, তত রমরমা কোচিং ব্যবসা চলবে। আমার এক ছাত্র কোচিং ব্যবসায় জড়িত। তাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, স্যার আমিও ঠিক বুঝি না। বিদগ্ধ শিক্ষক দ্বারা সমস্যাগুলো সলভ করে আনি। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই চলছে। পৃষ্ঠা ১৬-তে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ এবং প্রশ্নমালা। তারপর আবার কয়েকটি লাইন। তারপর ওজন, আকৃতি, আয়তন একসঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা। হায়রে, ৯ বছরের শিশুদের ঘাড়ে পড়বে এমন কঠিন খড়্গ! লেখকদের ভাবখানা বুঝি এমনই। পৃষ্ঠা ১৭-তে আবার প্রশ্ন। ওই পৃষ্ঠাতেই রয়েছে কাঠ, লিখে না দিলে সাত জন্মেও আমি কাঠগুলো চিনতাম না। একই অবস্থা কাচের ক্ষেত্রে। পৃষ্ঠা ১৮-তে রয়েছে। তারপর পানির অবস্থার পরিবর্তন। লক্ষ করো, এবার আঁকো। ছয়টি প্রশ্ন। এবার অবশ্য ঠিকমতোই লাল সতর্কবাণী। তার সঙ্গে রয়েছে প্রশ্নমালা। এরপর ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় জলীয়বাষ্প, পানির তিন অবস্থা, পরের পৃষ্ঠায় পদার্থের তিন অবস্থা আর চিরাচরিতভাবে ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রশ্নমালা। ১২টি অধ্যায় রয়েছে। এভাবে কি শিশুর মনের বিকাশ ঘটে?
চতুর্থ শ্রেণীর বইয়ের অবস্থাও একই। তবে অধ্যায় ১৩টি। আর পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যায় ১৪টি। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ের মতোই একই রকম। কেননা লেখকরা তো একই রকম। পরিমার্জনেও একই। তাহলে এত ভালো রেজাল্ট কীভাবে করছে? বিশ্বাস করুন, একটি ব্যক্তিগত সত্য বলি। কেমিস্ট্রি বুঝতাম না। আমার আব্বার এক ছাত্র আবদুল হক স্যার বললেন, বোঝার দরকার নেই, তুই খালি মুখস্থ করবি। স্যারের কথা সত্যিই বেদবাক্য হয়েছিল। লেটার পেয়েছিলাম। কিন্তু মনে শান্তি ছিল না।
এবার আসি মূল সমস্যা সমাধানের উপায়ে। সংশ্লিষ্টদের বিনীতভাবে অনুরোধ জানাব, দয়া করে প্রাথমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান বইগুলো পরীক্ষা করে দেখার ব্যবস্থা করুন, দরকার হলে তারকাখচিত শিক্ষকমণ্ডলীকে নসিহত করুন- তারা যেন বাচ্চাদের বয়স অনুপাতে বই রচনা করেন। বইয়ের খোলনলচে বদল করা দরকার। এ শিশুরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে বিজ্ঞান বই ক্লাস থ্রিতে না পড়িয়ে বরং ল্যাবে দেখানো হয়। এমনকি ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে দেখেছি ল্যাবে রোবট বানাতে। বিজ্ঞানচর্চা করতে হলে মুখস্থ বিদ্যা বাদ দিয়ে বরং হাতে-কলমে চর্চা করা বিধেয়। সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবশ্যই ল্যাব চালু করতে হবে। এজন্য সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যারা ওইসব স্কুল থেকে পাস করেছেন, সাবেক অ্যালামনাইরা চাঁদা দিয়ে ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে পারেন। পাশাপাশি শিক্ষার নামে যে বোঝা চাপানো হচ্ছে, যা আমি ইতিপূর্বে বাংলা বই পর্যালোচনা করে পেয়েছি, সেগুলোও দূর করা দরকার। মনে পড়ে আমার বিজ্ঞান শিক্ষকের কথা- ল্যাবে নিয়ে গিয়ে কী সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু আমাদের দেশে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর সব স্কুলে কি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? এটি মাথায় রেখে বইয়ের ব্যাপক সংস্কার এবং মুখস্থ বিদ্যার চেয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা ও ছোট ছোট মনকে পড়াশোনার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের ধাপে ধাপে অগ্রগতিতে কম্পিউটার ও মোবাইলের মাধ্যমে পাঠ ও পঠনে অগ্রগতি ঘটানো। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জন্য বেতন বৃদ্ধি করেছে, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে, শিক্ষক নিয়োগে তৎপর হতে বলেছে। এখন দয়া করে শিক্ষকরা যেন শিশুদের বয়সী বই সুন্দরভাবে রচনা করেন, পড়াশোনা যাতে দেশের কোমলমতি শিশুদের জন্য বোঝা না হয়।