শিশুর খেলা কেন হবে যন্ত্রণা ? - Dainikshiksha

শিশুর খেলা কেন হবে যন্ত্রণা ?

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

২২শে এপ্রিল ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ছয় বছরের শিশুকে রাজধানীর শ্যামপুর এলাকায় পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করার সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এ হৃদয় বিদারক ঘটনা আবারো জাতির বিবেককে দারুনভাবে নাড়া দেয়। শিশুটি না হয় একটু দুষ্টুই ছিল। এ জন্য কি তার এ করুণ মৃত্যু?

ছয় বছরের শিশু মো. আবদুল্লাহ শুধূ নিজের বাড়ি নয়, আশেপাশের এলাকায়ও সবাইকে মাতিয়ে রাখত তার অধিকতর চঞ্চলতা দিয়ে। তার এক ধরনের বিশেষ খেলা ছিল অন্যের গায়ে পানি ছিটানো। বিষয়টিকে শিশুটি নিতান্তই খেলা হিসেবে উপভোগ করত। এ খেলার মাধ্যমে অন্যকে বিরক্ত করা অপরাধ। এ বোধশক্তি শিশুটির মধ্যে জাগ্রত হয়নি। এ প্রসঙ্গে একটি গল্পের অবতারনা করছি।

খালের পানিতে কিছু ব্যাঙ বসবাস করতো। তারা প্রতিনিয়ত সাঁতার কাটতো। পাশের পথ দিয়ে কতিপয় ছোট্ট শিশু স্কুলে যেত। আসা যাওয়ার পথে তারা প্রায়ই ব্যাঙদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে খেলা করার মাধ্যমে খানিকটা আনন্দ উপভোগ করতো। আনন্দের মাঝে করুণ পরিণতি বা খারাপ অভ্যাসগুলো নিয়ে শিশুদের বিভিন্ন কৌশলে বা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিশুর উপলব্ধি বোধ জাগ্রত করা যেত। তাহলে তারা পানি ছিটানোর মত খেলা বা ব্যাঙের ওপর আঘাত হানা খেলা অনায়াসে বন্ধ হতো।

পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দায় এড়াতে পারে না। শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টা তো প্রশ্নই আসে না। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে শিশু অধিকার পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইন পরিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও কর্মস্থল সবার জন্য প্রযোজ্য। অথচ আজকে প্রশ্ন জাগে আমরা কী পেরেছি শিশুদের শারীরিক, মানসিক শাস্তি থেকে মুক্ত রাখতে?

কয়েক বছর আগে ঢাকার নয়াটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র দিপুকে শারীরিক নির্যাতনের জন্য অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তখন প্রথম আলো পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছিলাম “দিপুর মত আর কেউ যেন হারিয়ে না যায়” শিরোনামে। অথচ অগণিত শিশু আজও শারীরিক অমানসিক নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে। আজ সময় এসেছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও চ্যালেঞ্জ সমূহ দূর করার। শিশুর শারীরিক মানসিক শাস্তির কতিপয় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোকপাত করছি:-

পরিবার তথা সমাজের অজ্ঞতা:

পরিবারে মা, বাবা ও অভিভাবকেরা শিশুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে থাকেন। তাদের অনেকের বদ্ধমূল ধারণা শাসন বা না পিটালে শিশুরা বড় হয়ে মানুষ হবে না। আমাদের সন্তানরা তো সৃষ্টির সেরা জীব। কোন প্রাণী নয়। তারা শিশুর যে কোন খেলা, সৃষ্টিশীল কর্মকা- দুষ্টামি হিসেবে আখ্যায়িত করে বিরক্তবোধ করে। শিশুকে আদর, সোহাগ, ভালবাসা দিয়ে ভবিষ্যতের আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছেন।

যেমন আজকের অধিকাংশ অভিভাবক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষা এ বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। জ্ঞান অর্জন ব্যতিরেকে ভাল রেজাল্ট জিপি-৫ এর জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে। ইসলাম ধর্মেও শিশু নির্যাতনসহ সকল নিপীড়ন কবিরা গুনাহ হিসেবে নির্দেশনা দিয়েছে। নিজের সন্তানসহ সকল শিশুকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া শিশুর ওপর নির্যাতনের শামিল। শিশু নির্যাতন আইনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরিবারে অধিক শিশু:

পরিবার বড় হলে বা শিশুর সংখ্যা বেশি হলে তাদের সঠিক যতœ বা দেখাশুনা সম্ভব হয়ে উঠে না। অস্বচ্ছল পরিবার হলে অভাবের যন্ত্রনা মেটাতে সন্তানদের খোঁজখবর যতœ অনেকটা হারিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের বড়রা শিশুদের খেলা ও চিত্ত বিনোদনের পরিবর্তে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিয়ে নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে সাময়িক স্বস্তি অনুভব করে।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি:

শিশুর স্বাভাবিক খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, পাঠ্যবই বর্হিভূত বইপড়া, সামাজিক, জাতীয় ও বিশেষ দিবস উদযাপনে অংশ্রগহণ বা বিশেষ দর্শনীয় স্থানে যাওয়া আজও সমাজ ও পরিবার সুনজরে দেখে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো শিশু স্কুলে যাবে, কোচিং বা বাসায় পড়াশোনা করবে। শুধু গৃহ, স্কুল ও কোচিংযে বন্দী হয়ে থাকবে ও জিপি-৫ ফলাফল নিশ্চয়তা দিবে। অভিভাবক ও সমাজ বুক টান করে অহংকার করবো। সূর্যের আলো, মুক্ত বাতাস ছাড়া গাছ যেমন লিকলিকে বা ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারে না তেমনি পরিপূর্ণ জ্ঞান বিকশিত ছাড়া শিক্ষার্থীর আজকের খন্ডিত জ্ঞানে ভাল ফলাফল অর্থহীন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করণীয়:

শিক্ষক সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটা চালাতে হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির মাধ্যমে। শিক্ষকেরা সমাজের একজন হিসেবে কারো কারো মতে “মাইর ছাড়া” শিশুদের শিক্ষা দান কষ্টকর। পাঠদান বর্হিভূত কাজের চাপে ও এক নাগাড়ে ৭টা-৮টা বিরামহীন ক্লাস ও শিক্ষক সংকটে একসাথে, একাধিক ক্লাসে দৌঁড়ঝাঁপ শিক্ষকদের ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক কথাবার্তাও শিক্ষকদের মাঝে চরম বিরক্তি সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা খেলাকে হৈ চৈ, গোলমাল বা দুষ্টামি আখ্যায়িত করতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকেরাও গুলিয়ে ফেলে।

একটু লাঠি কিংবা বেত বা ধমক দিয়ে তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়। শিক্ষকদের বেত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তাদের কেহ কেহ নির্দেশিকা কাঠি বলে খোড়া যুক্তি দেখায়। কেউ কেউ অধিক ক্লাস নেওয়ায় মানসিক শান্তি হিসেবে এর খানিকটা ব্যবহার তুলে ধরে। আশির দশকে ঢাকার মতিঝিল থানার পূর্ব খিলগাঁও স্কুলের এনামুল হক নামে শিক্ষককে শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন এর কারনে দোহার উপজেলায় বদলী করা হয। নানা প্রকার প্রশাসনিক শাস্তি ও আইন কী পেরেছে এ থেকে মুক্তি দিতে? প্রতিবন্ধতা দূর না করে শুধু শাস্তি, সফলতা বয়ে আনতে পারে না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা:

শিক্ষার পরিবেশ আনন্দদায়ক ও শিশুর পাঠদান পদ্ধতি পারে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি না করতে শিক্ষকদের অনেকটা বাধ্য করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি অনেকটা যত দোষ নন্দ ঘোষ প্রবাদের মত। স্কুলের শিক্ষার্থীর পাঠদানকে ব্যাহত করে সমাপনী পরীক্ষা বা অনাহুত কাজে থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসকে সেবা বা যত্ন করার জন্য শিক্ষকদের নিয়োজিত রাখা, সারাদেশে শিক্ষক সংকট বর্তমানে তলানিতে অবস্থান করছে। প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি ৯ বছর যাবৎ বন্ধ করে ও শিক্ষক সংকটে নিমজ্জিত রেখে বড় বড় কর্মকর্তাদের লম্পঝম্প কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে? শিশুর শারিরীক মানসিক শাস্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূর করার জন্য পরামর্শ উপস্থাপন করছি:

দোষী ব্যক্তি শাস্তি পাবে এ ব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান। অথচ কোন প্রেক্ষাপটে দোষী হলো এ ভাবনাটুকু অনেকেরই মাঝে নেই। বিদ্যালয় শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের পাঠদান থেকে বিরত রেখে অন্য কাজ করানো, শিশুর শারীরিক মানসিক শাস্তি ভোগের অন্যতম কারন। সমস্যা সমাধানে বাজেটের অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ, সংকট দূরীকরণে সময়ক্ষেপণ অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা শিশুর ওপর নির্যাতন তথা শিক্ষার অধিকার হরণ করার দায় এড়াতে পারে না।

পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করে স্কুল হোক শিশুর স্বর্গ। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র আবাসস্থল শিশুর স্বপ্নপুরী তৈরিতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। দূর হোক শিশুর ওপর সকল নির্যাতন। এ প্রত্যাশায়।

 

মোঃ সিদ্দিকুর রহমান: আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম, দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034549236297607