সিলেটের শিশু রাজন ও খুলনার শিশু রাকিব হত্যার পর আরো অনেক শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। সম্প্রতি হবিগঞ্জের বাহুবলে ৪ শিশু নিতান্তই গ্রামের অপরাজনীতির জন্য, কুমিল্লা ২ শিশু ভাইয়ের হাতে এবং ঢাকায় ২ শিশু মায়ের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে এমন অভিযোগ আমরা দেখতে পাই। এখন এ শিশুগুলো সম্প্রতি হত্যার শিকার শিশুদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাও মাত্র কয়েক দিনের মাথায়।
আর খুনের পদ্ধতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তা নিতান্তই তুচ্ছ জ্ঞান করে অমানবিক কায়দায় খুন করা হচ্ছে। শিশু হত্যা হূদয়কে করুণভাবে নাড়া দেয় ঠিকই। কিন্তু বাজারে আর একটি শিউরে উঠার খবর এলে এ খবর যে ঢাকা পড়ে যাবে! প্রতি বছর রাজন, রাকিব, জয়, মেহেদী, রিয়াদ, অরনী ও আলভীর মত অনেক শিশু নৃশংস হত্যার শিকার হয়। কয়েকটা হত্যা আমাদের চক্ষু গোচর হয়েছে মাত্র।মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২৬, ২০১৩ সালে ১২৮, ২০১৪ সালে ১২৭, ২০১৫ সালে ১৯৩ (বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি) শিশু হত্যার শিকার হয়েছে!
শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে দেখা গেছে, গত সাড়ে তিন বছরে ৭৭৭ জন শিশু নির্যাতনে মারা গেছে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ শিশুকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে (দৈনিক ইত্তেফাক: ৬ আগস্ট, ২০১৫)। কিভাবে কত কায়দায় শিশু হত্যা করা যায় এ যেন তারই এক প্রতিযোগিতা। সামাজিক অবক্ষয় ও শিশু হত্যার বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ভয়ঙ্কর হত্যা দিন দিন বাড়ছে বলে মত দিয়েছে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। আমিও বিশেষজ্ঞ মহোদয়বৃন্দের সাথে এক মত তবে একটু আলাদাভাবে।
আমাদের নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব ঢের রয়েছে তা অকপটে শিকার করতে হবে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে এবার আসুন যিনি বা যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন তাদের কি করা যাবে? আইনের হাত যে অনেক লম্বা তা তাদের দেখাতে হবে। শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শিশুর প্রতি সহিংসতার জন্য অনেকটাই দায়ী। শিশুদের হত্যাকারীরা জানে যে হত্যার পরে একটু দৌড়ালেই পার পাওয়া যাবে। তাদের আশ্রয় দাতা আছে। আছে গডফাদার। দেশে আইনের অভাব নেই। অভাব কেবল তা প্রয়োগের ও নৈতিক মূল্যবোধের।
খুনের শিকার শিশু ও পরিবারের মূল্য ঘাতকদের কাছে যেন বাজারে কচুর লতি কেনার মত। তারা জানে এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের বিচার পাওয়ার ক্ষমতা নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, অপরাধীদের পূর্বের বিচার না হওয়া এর একটি প্রধান কারণ। আইনের কঠোর প্রয়োগ অব্যশই দরকার এবং সেই সাথে দরকার পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতার জন্য বিশেষ কার্যক্রম।
একদিকে শিশু নির্যাতন অন্যদিকে শিশু হত্যা। এ যেন একে অপরের পরিপূরক। যখন একটি শিশুর মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর কথা তখন নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের পেটের টানে রাস্তায় নামতে হয়। সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিবের পর বরগুনায় শিশু রবিউল আউয়াল (১০) নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারালো। মহামান্য আদালত রাজন ও রাকিবের হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করলেন। এরপরও থেমে নেই শিশু হত্যা।
প্রতিশোধের সহজ টার্গেট হওয়ায় বাড়ছে শিশু হত্যা। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই হত্যার শিকার হয়েছে ২৯ শিশু (দৈনিক ইত্তেফাক ২মার্চ, ২০১৬)। গত বছর মাগুরায় ছাত্রলীগের এক সংঘর্ষে গর্ভবতী মায়ের পেটে গুলি করে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে এক শিশুকে। জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে? বিচার হয়েছে, বিচারে দোষীরা শাস্তির বার্তা শুনেছে কিন্তু গত বছর নির্মম নির্যাতনে নিহত হওয়া রাজন, রাকিব ও রবিউল কি ফিরতে পেরেছে পরিবারের কাছে। এই তিনজনের মধ্যে ব্যাপক মিল রয়েছে যেমন, নামের শুরু ‘র’ দিয়ে। লেখাপড়া একই শ্রেণিতে।
বয়সও প্রায় সমান, রাজনের ১৩, রাকিবের ১২ আর রবিউলের ১০। তিনজনই গরীব পরিবারের। বাঁচার জন্য আকুতি করেছিল রাজন, কিন্তু সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের কাছে তা আকুতি পৌঁছায়নি। শিশু আইন আছে, শিশু অধিকার সনদ আছে। শিশুকে শারীরিক তো নয়ই, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা নিষিদ্ধ। শিশুশ্রমের বিপরীতে কঠোর শাস্তির বিধানও আছে। তবে এসবের প্রয়োগ কোথায়?
লেখক: মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, শিক্ষার্থী, চূড়ান্ত বর্ষ, বিএসএস (নৃবিজ্ঞান বিভাগ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।