হঠাৎ দু-একটি নৃশংস অপরাধ সব সমাজে চিরকাল সংঘটিত হয়েছে। সেই অপরাধের দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। কিন্তু সমাজে একই ধরনের অপরাধ যখন অনবরত সংঘটিত হয়, তখন বুঝতে হবে সমাজ নিজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অপরাধ সংঘটিত করছে ব্যক্তি, কিন্তু তার পেছনে রয়েছে সমাজ। সমাজের চিকিৎসা না করে শুধু ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে, এমনকি শাস্তি দিয়ে, সমাজকে অপরাধমুক্ত করা সম্ভব নয়।
পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, গত ১২ মাসে ৩৮০ জনের বেশি শিশু নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি শিশু (মেয়ে ও ছেলে) খুন হয়েছে। শিশুর সংজ্ঞায় যদি ১৬ বছরের কম বয়স্কদের ফেলা হয়, তাহলে শিশুহত্যার সংখ্যা আরও বেশি। মেয়েশিশুদের অনেককেই প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। এই সব হত্যাকাণ্ডের কারণ ও ধরন বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমাদের সমাজকে দায়মুক্তি দেওয়া যায় না।
আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে মাঝে মাঝে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তার দায় শুধু ওই খুনিদের ওপর চাপানো যায় না, রাষ্ট্র ও সমাজের ওপরও বর্তায়। সেখানে সংবিধান অনুমোদিত সমাজব্যবস্থার কারণেই খুনি তৈরি হয়। আগ্নেয়াস্ত্র রাষ্ট্র তুলে দিয়েছে নাগরিকদের হাতে, ক্রিকেট-হকি খেলার সরঞ্জামের মতো। তবে বৈধ অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটলে খুনিদের বিচার হয়, শাস্তিও হয় কিন্তু খুনখারাবি কিছুমাত্র কমে না। সমাজ নতুন নতুন আততায়ী অবলীলায় তৈরি করে।
তা ছাড়া, মানুষ হত্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে ডাল-ভাত। তারা দেখছে পৃথিবীর দেশে দেশে তাদের সরকার হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। তাদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু। জাতির মনোজগৎ নানা উপাদানে গঠিত হয়। রাষ্ট্রের চরিত্রের সঙ্গে নাগরিকদের মনোজগতের মিল থাকে। মানুষ যখন দেখে সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্র নিজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তখন সেও অপরাধ ঘটাতে উৎসাহ পায়।
রাজন, রাকিব হত্যাকাণ্ড মিডিয়ার কারণে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওগুলোর দ্রুত বিচার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতি দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছিল। মানুষ তার প্রশংসা করেছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গে একজন সাংসদ দিনদুপুরে তাঁর দামি গাড়ি থেকে নেমে একটি শিশুকে গুলি করেন। গুরুতর আহত হলেও সৌভাগ্যক্রমে ছেলেটি প্রাণে বেঁচে যায়। শতভাগ ৩০২ ধারার মামলা। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ লক্ষ করল খুনিকে বাঁচানোর জন্য প্রশাসনের কী আপ্রাণ চেষ্টা! তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে কয়েক দিন আত্মগোপনে বা বিশেষ হেফাজতে থাকতে প্রশাসন সাহায্য করল। তারপর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করে এখন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বললেও বাস্তবতা তা নয়। মনে হয় যেন কারও খুনখারাবি করার অধিকার রয়েছে ষোলো আনা, অন্য কারও কিছুই না করে হত্যা ও যানবাহন পোড়ানোর মামলায় জড়িয়ে জেলের ভাত খাওয়ার সুবন্দোবস্ত হয়েছে। এসব সাধারণ নাগরিকের মনোজগতে প্রভাব খুবই গভীর। এবং তার প্রকাশ ঘটে বিচিত্র রকম জঘন্য অপরাধের মাধ্যমে।
মানুষ যখন সেই সব অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়, তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ও সহিংসতার প্রকাশ ঘটতে পরে। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের কাছে দক্ষিণ বাংলার এক লোক তাঁর দুঃখের কথা আমাকে জানালেন। তাঁর পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ভাতিজা এসএসসি পাস করে পুলিশে চাকরির জন্য আবেদন করেছিল যথাযথ প্রক্রিয়ায়। তাঁর গ্রামেরই এক রোগা পটকা ছেলে, উচ্চতা সম্ভবত পাঁচ ফুটের কম, শরীরের জোর বলে কিছুই নেই, তার চাকরি হয়েছে। কী প্রক্রিয়ায় হয়েছে তা যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, তাঁরা এবং বিধাতাই শুধু জানেন। যে যোগ্য ছেলেটি চাকরি পায়নি, তার পক্ষে শান্তিপ্রিয় ও নীতিমান থাকা খুবই কঠিন। লোকটি বললেন, তাঁদের পরিবার ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগপন্থী কৃষক লীগ করে। কিন্তু তাঁদের অবস্থা ভালো না। পাঁচ-দশ লাখ টাকা খরচ করার ক্ষমতা নেই।
পাড়ায় পাড়ায় মানুষ যদি স্বার্থের জন্য কোন্দল করে এবং সে কারণে নৃশংসতার শিকার হয় শিশুরা, সেখানে সরকারও কিছু করতে পারে না। সেখানে ভূমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় সমাজের নেতারা। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় গত হপ্তায় পঞ্চায়েতের দ্বন্দ্বের কারণে চার শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা দিয়ে রেখেছিল খুনিরা। ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছে। ঘটনাটি নির্মমতার এক চরম দৃষ্টান্ত। ওই ঘটনার তিন–চার দিন পরে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় পাওনা টাকা না দেওয়ায় ১২ বছরের এক শিশুকে হত্যা করে লাশ একটি ঘেরের ভেতর ফেলে রাখা হয়। সেখানেও খুনি শনাক্ত হয়েছে। বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হলে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হবে। কিন্তু ওই শিশুদের তো আর তাদের মা-বাবা ফেরত পাবেন না।
শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, আমাদের সমাজে করুণা, স্নেহ-মমতার অভাব নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, যা চট করে চোখে পড়ে না। জীবনের প্রতি মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ শোচনীয়ভাবে কমে গেছে। আবুল বাজনদার নামে এক হতভাগ্য তরুণ এক অস্বাভাবিক রোগ বা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তাঁর দুঃখের শেষ নেই। তিনি দাবি করেন সব মানুষের দোয়া। তাঁকে আমাদের পত্রপত্রিকা ‘বৃক্ষমানব’ ‘ট্রি-ম্যান’ বলে আখ্যায়িত করছে। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য অতি সংক্ষেপে শুধু এইটুকু যে এই রোগে যদি কোনো বড় রাজনৈতিক নেতা, পদস্থ আমলা, শিল্পপতি, সাংবাদিকদের সন্তানদের কেউ আক্রান্ত হতেন, তাকে আমাদের সাংবাদিকেরা ‘বৃক্ষমানব’ বা ‘ট্রি-ম্যান’ বলে আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন করতেন কি না? আবুল বাজনদার একজন নিম্ন আয়ের মানুষ। আমরা শ্রদ্ধা ও মমতা প্রকাশে নিরপেক্ষ নই। তাঁকে ‘বৃক্ষমানব’ বলে সম্বোধনকে আমার কাছে মনে হয়েছে নির্মমতম পরিহাসের মতো।
সমাজ ও রাষ্ট্রকে মানবিক করা সাধনাসাপেক্ষ। যেসব প্রবণতা সমাজকে নষ্ট করে, সমাজে সম্প্রীতি, শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে, তা শনাক্ত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কর্তব্য। শুধু ঘটনা বিশেষের পর মানববন্ধন করে সব অপরাধের প্রতিকার সম্ভব নয়। অপরাধের কারণ এবং তার সম্ভাব্য প্রতিকার খুঁজে বের করার জন্য অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, সমাজসেবক—সব ধরনের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
জঙ্গিবাদ শব্দটি যত বেশি উচ্চারিত, তা উত্থানের কারণগুলো নিয়ে কথাবার্তা খুবই কম। শিশুহত্যা জঙ্গিবাদের চেয়ে কিছু কম ভয়াবহ নয়। দেশে এক বছরে প্রায় ৪০০ শিশু-কিশোর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য যথেষ্ট নয়। গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করছে। রাষ্ট্র তার রুটিন কাজ করছে। কিন্তু সমাজ নীরব। অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, প্রতিহিংসাবশত হত্যাকাণ্ড, শিশুদের ওপর বিকৃত যৌনাচার প্রভৃতির প্রভাব গোটা সমাজব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ। যেসব এলাকায় এ–জাতীয় ঘটনা ঘটে, সেখানে লক্ষ করা গেছে বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার কম। দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় শিক্ষার হার বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় শিশু নির্যাতন ও শিশু হত্যাকাণ্ডের প্রকোপ সামাজিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দেবে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানেরা হবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমনের মতো শিশুহত্যার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এই সময়ের জাতীয় দাবি।
লেখক: সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক ও গবেষক।