শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিলেই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয় না - দৈনিকশিক্ষা

শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিলেই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয় না

মো. নাজমুল হুদা নাসিম |

শুধু আট ঘণ্টা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিলেই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয় না। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, ঝরে পড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ওইসব শিশুর স্বপ্ন দেখাতে হবে, নিজেও স্বপ্ন দেখতে হবে। একটি ভালো লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হলে শিশুদের পাশাপাশি নিজেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। এতে শুধু দেশে নয়; বহির্বিশ্বেও নিজের ও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এভাবেই নিজের স্বপ্নের কথা বললেন বিশ্বসেরা ৫০ শিক্ষকের পুরস্কার বিজয়ী বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন।

নিজের পেশায় অনবদ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু, প্রতিবন্ধী শিশু ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষাদানে অবদান রাখায় তিনি বিশ্বসেরা শিক্ষক-২০১৭ (গ্লোবাল টিচার প্রাইজ) পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে ‘গ্লোবাল টিচার পুরস্কার’ প্রবর্তন করে। বিশ্বের ১৭৯টি দেশ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক আবেদন করেন। সর্বশেষ বিভিন্ন দেশের ৫০ জন এ তালিকায় আসেন। শাহনাজ পারভীন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। ১৯ মার্চ দুবাইয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের শাহনাজ পারভীনের হাতে সনদপত্র তুলে দেয়া হয়।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার পশ্চিম দত্তপাড়ার মেয়ে শাহনাজ পারভীন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। বাবা মানিক উল্লাহ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। মা নুরজাহান বেগম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। জন্ম ১৯৭৬ সালে। ১৯৮৫ সালে মায়ের কর্মস্থল শেরপুরের উলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পান। ১৯৯০ সালে শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ প্রথম শ্রেণীতে দাখিল (এসএসসি) পাস করেন। পরের বছর ওই মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক ও শেরপুরের সাধুবাড়ি এলাকার মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শিক্ষানুরাগী বাবা-মা তার লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে বিয়েতে শাহনাজের নামে কিছু জমি লিখে দেন। স্বামী ও শাশুড়ির অনুপ্রেরণায় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৯২ সালে ওই মাদ্রাসা থেকে আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করেন। মাদ্রাসা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হওয়ায় ভালো ফলাফল করেও উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারেননি।

কিন্তু পড়ার অদম্য ইচ্ছা থেকেই বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ভর্তি হন। কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। পরে প্রথম শ্রেণীতে বিএড ও এমএড সম্পন্ন করেন। লেখাপড়া শিখে তা সমাজের কাজে লাগাবেন না এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাই বেছে নেন শিক্ষকতা পেশা। তিনি ২০০৩ সালের ৫ জুন শেরপুর উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতাকে তিনি ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে তুলেন এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। শিক্ষার্থীদের তিনি সহজভাবে পাঠ দেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পান ২০০৯ সালে উপজেলা, ২০১০ সালে জেলা ও ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি এই পদক গ্রহণ করেন।

শিক্ষাদানের পাশাপাশি সংসারকেও তিনি সমানভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার ঘর আলো করে আসে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স এবং ছোট মেয়ে আমিনা মুমতারিন শ্রেয়া বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। শিক্ষা জীবনে শাহনাজ পারভীন বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখি করতেন। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি তিনি তার লেখালেখি চালিয়ে যান। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেন। ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ’ এই বিষয়ে ২০১০ সালে তিনি গবেষণাপত্র ‘অনুসন্ধান’ রচনা করেন। তার প্রথম ছড়ার বই ‘পাখির মুখে ফুলের হাসি’ বের হয় ২০১৪ সালে। তিনি ২০১৫-১৬ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কাব লিডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। আইসিটি প্রশিক্ষণে জন্য ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়া সফর করেন।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নিজ উদ্যোগে শাহনাজ পারভীন একটি বিদ্যালয় খোলেন। বিদ্যালয়ের শুরুর গল্প প্রসঙ্গে শাহনাজ পারভীন বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে অনুভব করলাম অর্থ সংকটসহ নানা কারণে অনেক শিশু লেখাপড়া করতে পারছে না। আবার কেউ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ঝরে পড়ছে। অনেক প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব শিশুদের জন্য কিছু করতে মন চায়। উদ্যোগ নিলাম। পরিবারের সদস্যরাও সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। স্বামী, দুই মেয়ে, মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় শেরপুরের শান্তিনগর এলাকায় নিজ বাড়িতে ২০১৩ সালে ‘শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ চালু করলাম। শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শ্রমজীবী, প্রতিবন্ধী, সুবিধাবঞ্চিত এবং বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের ভর্তি করলাম। অনেক কষ্ট করে এদের পোশাক, বই, টিফিনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র বিনা খরচায় দিই। বর্তমানে ২১৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ৭ জন শিক্ষক বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেন। বিকালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ফেরার পর আমিও ওদের ক্লাস নিই। প্রজেক্টের ব্যবহার, নানা কৌশল ও খেলার মাধ্যমে এসব শিশুদের লেখাপড়া শেখানো হয়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর বিদ্যালয়টি শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের অনুমোদন লাভ করে। অনেক কষ্টে কম জায়গায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেয়া হয়। ওদের খেলার জন্য নেই মাঠ। ডিসপ্লে করার জন্য অন্যত্র নিয়ে যেতে হয়। আশপাশের লোকেরা সহযোগিতা করলেও দক্ষিণ পাশের একটি পরিবার শিক্ষার্থীদের তাদের বাড়ির কাছে যেতে দেন না। তবে আমি বিশ্বাস করি, এভাবেই আমরা সমস্যা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। ভবিষ্যতে এ সমস্যা থাকবে না।

এ স্কুল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, যেসব শিশু এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করবে তাদের জন্য মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নচেৎ ওই শিশুরা আবার শিক্ষা থেকে ঝরে পড়বে। এই লক্ষ্য নিয়ে আবারও অগ্রসর হব নতুন উদ্যমে। কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি শিশুদের স্বপ্ন দেখাব। ওদের নিয়ে আমিও স্বপ্ন দেখব। লক্ষ্য ছাড়া কিছু হওয়া যায়; কিন্তু সেরা হওয়া যায় না। আমার এ বিশ্বসেরা সম্মান পাওয়ার নেপথ্যে ‘শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এ বিদ্যালয় শুধু শেরপুর উপজেলায় নয়; জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দিতে চাই। এজন্য দরকার সমাজের সর্বস্তরের শিক্ষানুরাগীদের সহযোগিতা।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033278465270996