সত্যিই কি উত্তর আমার জানা নেই? - দৈনিকশিক্ষা

সত্যিই কি উত্তর আমার জানা নেই?

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ |

দুুটো অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। প্রথম গল্পটি বেশ কয়েক বছর আগের। ঘটনার অনুঘটক ছিপছিপে গড়নের সাদামাটা চেহারার একটি ছেলে। গায়ের রং শ্যামলা। কথা বলার ঢংয়ে একটা বিনীত ভাব। বললো স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবো। আমি শিক্ষকতার বাইরে তখন অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব পালন করতাম। সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব। সেই সূত্রে মাঝে-মধ্যে বিচিত্র সব বিষয়ে পরামর্শ চাইতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা হতো। আমাদের অফিসে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা মনোবিজ্ঞানী আছেন। তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নানা জটিল ও বিচিত্র মনো-সমস্যা রয়েছে। ভালো লাগতো যখন দেখতাম মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে থেকে অনেক ছেলে-মেয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসছে। আরো একটি কাজ শুরু করেছিলাম এই কেন্দ্রে। তালিকা তৈরি করেছিলাম শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। যে অভিভাবকরা বাড়িতে পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটর চান এবং যে ছাত্ররা টিউশনি পেতে আগ্রহী আমরা তাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরির দায়িত্ব পালন করেছি।

এই দুই প্রয়োজনেই ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি আসতো কেন্দ্রে। অবশ্য এসবের জন্য আমার কাছে সরাসরি আসার প্রয়োজন পড়তো না। এ জন্য এই ছেলেটি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কারণ চট করে বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওকে সামনের চেয়ারটিতে বসতে বললাম। সামান্য দ্বিধা নিয়েই ও সব কথা খুলে বললো। ধরে নেই ওর নাম মাসুদ। কলা অনুষদের একটি বিভাগে পড়ছে। বললো ওর নিজের কথা। সাতক্ষীরা বাড়ি ওর। বরাবর মেধাবী ফলাফল করেছে। মেধার প্রমাণ রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাসুদ। তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন স্কুলের শিক্ষক কবির স্যার এবং এলাকার বড় ভাই শেখ ইয়াসিন। তারা আর্থিক সহায়তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। বাবা ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ছয়জনের সংসার নির্বাহে হিমশিম খান। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তার জন্য বিলাসিতা। মাসুদ তিনটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। চেষ্টা করে বাবাকে পাঁচ-সাতশ টাকা পাঠাতে। আর প্রতিদিন দিন গোনে কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবে। চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরবে। ওর কাছে এক একটা দিন এক একটি বছরের মতো।

সেই সময় তিন বছরে রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী ঝামেলায় মাঝে মাঝে ক্লাস পরীক্ষার বিঘ্ন ঘটেছে। সামান্য সেশন জট তৈরিও হয়েছে। সেই তুলনায় শেষ এক বছর স্থিতিশীল ছিল। এর মধ্যে নানা কারণে মাসুদের আর্থিক সংকট বেড়েছে। এখন সেশন জটের আশঙ্কা ওকে বিমর্ষ করে। সে বছর মে মাস থেকে ওকে খুব শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের একটি অংশের আন্দোলন। বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাস নিলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অনেকেই নিচ্ছিলেন না। কষ্টের সঙ্গে মাসুদ জানালো যখন অধিকাংশ কোর্সের ক্লাস শেষের দিকে তখন আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতা মাত্র দুটো ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষকদের ক্লাস ধর্মঘট ও ব্যক্তিগত অসাধুতায় ক্লাস না নেওয়ার কারণে ওদের হিসাবে ছয় মাস থেকে এক বছর সেশন জটের ফাঁদে পড়ে যাবে। মাসুদের পক্ষে টিকে থাকার সংগ্রামে এ এক কঠিন সংকট।

মাসুদ প্রশ্ন করে স্যার, এ থেকে বেরুনোর উপায় কী? শিক্ষকরা কি আমাদের কথা একবারও ভাববেন না?। আমি বিব্রত। কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললাম—মাসুদ, এর উত্তর আমার জানা নেই। পরক্ষণেই মনে হলো এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়তো! সত্যি কি উত্তরটি আমার জানা নেই?

দ্বিতীয় গল্পটি সাম্প্রতিক সময়ের। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি যুদ্ধ চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একটি দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। প্রায় দুই হাজার আসনের বিপরীতে নাকি তিন লক্ষাধিক আবেদনপত্র বিক্রি হয়েছে। বহু কোটি টাকা আয় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম আট দিনের জন্য বন্ধ। পরীক্ষা নিতে নিতে ক্লান্ত শ্রান্ত শিক্ষকগণের এই আট দিন লেখাপড়া আর গবেষণা এবং নষ্ট রাজনীতি চর্চা শিকেয় উঠেছে। প্রতিদিন পরীক্ষার্থী ছেলে-মেয়ে আর তাদের অভিভাবকদের পদভারে জনারণ্য হয়ে গেছে ক্যাম্পাস।

এমনি এক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পিওন জানালো আমার গেস্ট এসেছে। আমার রুমে বসেছেন তারা। প্রতি শিফটের পরীক্ষার পর ৩০ মিনিটের একটি বিরতি পাওয়া যায়। আমি আমার অফিস কক্ষে এলাম। দেখি একজন প্রৌঢ়া, একজন ৩০-৩৫ বছর বয়সের মহিলা আর একজন তরুণ। বুঝলাম এই তরুণটিই পরীক্ষার্থী।

প্রৌঢ়াকে খানিকটা চেনা চেনা লাগছিল। বাকিরা অচেনা। প্রৌঢ়া বুঝলেন আমি চিনে উঠতে পারছি না। তিনি সাহায্য করলেন। জানলাম তিনি গ্রাম-সম্পর্কে এক ভাইয়ের স্ত্রী। ভাই গত হয়েছেন বছর তিনেক আগে। এবার এই সম্পর্কিত ভাবিকে চিনতে পারলাম। হয়তো বছর বিশেক আগে শেষ দেখেছিলাম।

তার কাছ থেকে যা জানলাম তাতে খুব অসহায় মনে হলো নিজেকে। এই পরিবারটি বরাবরই খুব সচ্ছল ছিলেন না। ভাই মারা যাওয়ার পর আরো সংকটে পড়েছেন। সঙ্গে আসা বড় মেয়ে সংসার করছে মুন্সিগঞ্জ শহরে। এই ছেলেটির ওপরেই যত আশা ভরসা। এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে নেমেছে এখন। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কিনেছে। ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম ও সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার। কিন্তু আর্থিক সাধ্যে কুলায়নি। ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে অনেক খরচা আছে। ফরম কেনা, যানবাহন আর খাওয়া-দাওয়ার খরচ। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় না হয় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকতে পেরেছে। রাজশাহীতে গেলে হোটেলে থাকতে হবে। এসবের জন্য হাতে টাকা ছিল না। তাই বাড়ির দুটো গাছ বিক্রি করেছে ১৫ হাজার টাকায়। এর আগে কষ্টে জমানো টাকা খরচ হয়েছে ভর্তি কোচিং করতে গিয়ে।

ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বেরিয়েছে। তালিকায় আসেনি। কিছুটা হতাশা ছেলেটির কণ্ঠে। আমি সাহস দিলাম। এই বিশাল প্রতিযোগিতায় এখন ভর্তিটা লটারির মতো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা আসন সংখ্যা আছে তার দশগুণ বেশি ভর্তি করলেও প্রকৃত মেধাবী সকলকে জায়গা দেওয়া যাবে না। সুতরাং, হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিজের সাধ্যমত পরীক্ষা দাও।

বললাম বটে—তবে ভীষণ বিষণ্ন লাগলো নিজেকে। ওর মতো বা ওর চেয়েও খারাপ পারিবারিক অবস্থা থেকে আসা ছেলে-মেয়ে অসংখ্য। এদের মধ্যে প্রকৃত মেধাবীর সংখ্যাও কম নয়। রাষ্ট্রের সাধ্য নেই যথাযোগ্য জায়গা দেওয়ার। ছেলেটির হতাশ হওয়ার আরেকটি কারণ সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে পারবে না। ওর বোন প্রশ্ন করলো কেন এই নিয়ম করা হলো? যদি এমন হতো আবেদনকারীদের ৬০ ভাগের জন্য আসন আছে, তবে মানতাম বাকি ৪০ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু বাস্তবে যোগ্যদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভর্তি হতে পারছে। তা হলে দায় তো ছাত্রের নয়—দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্ষমতার। সুতরাং, একজন মেধাবী ছেলে বা মেয়ে লড়াই করার সুযোগটা কেন হারালো? এর জবাব কী! জবাবটা আমিও দিতে পারলাম না। কারণ যখন থেকে এই নিয়মের কথা শুনেছি তখন থেকে আমিও জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছি। জবাব একটাই— তা হচ্ছে আমরা আমাদের ‘ঝামেলা’ মুক্ত রাখতে চেয়েছি।

একই প্রশ্ন জেগেছে এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নীতিমালা দেখে। ভর্তির আবেদন করার যোগ্যতার ক্ষেত্রে সিজিপিএ কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় নিচের দিকের বেশিরভাগই এই বিশাল প্রতিযোগিতায় টিকবে না। তবুও বেনিয়ার মতো যেন ওদের প্রলুব্ধ করা হলো। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম কেনার সুযোগ না পেলেও এখানে পারছে। তাই জোয়ার বইয়ে গেল ফরম কেনার। ৫০০ টাকা দামের ফরম প্রায় তিন লক্ষ বিক্রি হলো। বাণিজ্য খুব ভালো হলো বলা যায়। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের পরীক্ষা-সংক্রান্ত কাজের সম্মানী হিসেবে এর একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যায় হবে আর বাকি টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ‘উন্নয়ন’ হবে। সাকুল্যে দুই হাজারের নীচে ভর্তি করা হবে জেনেও তিন লক্ষ পরীক্ষার্থীকে লটারিতে নামানোর কী অর্থ আমি জানি না। আর চলমান পদ্ধতিতে দীর্ঘ আট দিন পরীক্ষা নেওয়ার মচ্ছবের কী অর্থ থাকতে পারে তাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

নিরূপায় মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচতে চায়। যে ফরম কিনে সেই আশা করে হয়তো চান্স পেয়েও যেতে পারে। তাই বাড়ির গাছ বিক্রি করে হোক, জমি বেচে হোক, ঋণ করে হোক ভর্তি কোচিং থেকে শুরু করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সারা দেশ চষে বেড়ানোর সংস্কৃতিতে আমরা জড়িয়ে ফেলেছি বিপন্ন পরিবারগুলোকে। ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞজনরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু সম্ভবত বণিক মানসিকতার কাছে সকল সুবচন মার খাচ্ছে।

এই বাস্তবতার দিকে করুণ দৃষ্টি রেখে আমি সামনে বসা প্রৌঢ়া ভাবির দিকে তাকালাম। তার বিষণ্ন পাণ্ডুর দৃষ্টির কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। পরীক্ষার্থী ছেলেটির চোখও অনেকটা নিষ্প্রভ। কিছুক্ষণ পর বুকভরা হতাশা নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকবে। এই বিশাল সমুদ্রে কতটুকু সাঁতার কাটতে পারবে জানি না। আমি কেবল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি ভাবি যাতে আর কোনো প্রশ্ন না করেন। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার জানা নেই। অন্যমন বলছে ‘সত্যিই কি জানা নেই!’

লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040562152862549