হেরে যাওয়া বা পিছিয়ে পড়া জীবনেরই একটা অংশ। একটা মানুষ তার জীবনে সবসময়ই সফল হবে না, হতে পারে না। তাই কেউ যেন বিফল হয়ে ভেঙে না পড়ে জীবনের সেই শিক্ষাটা খুবই প্রয়োজন। একটি সত্যি ঘটে যাওয়া ঘটনা বলি।
ছেলেটির দেশের বাইরে জন্ম এবং বড়ও হয়েছে ওখানেই। ডাক্তারি পড়ছিল। একদিন বড় রকমের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, নিজেই ড্রাইভ করছিল। শারীরিকভাবে ওর কিছুই হয়নি; কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষেরই হয়। এটা একটা অনেক বড় ‘ট্রমা’ হতেই পারে। যে কোনো ট্রমা যদি বেশিদিন ধরে মানুষকে বিপর্যস্ত করে রাখে, তাহলে অবশ্যই তার কাউন্সেলিং দরকার। বড়-ছোট সবার।
এমনকি ৫ বছরের একটা বাচ্চাও ভীষণ রকমের ধাক্কা পেতে পারে, যা হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারবে না; কিন্তু অন্য কোনোভাবে তার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। এই ধাক্কাগুলোকে ছোট করে না দেখাই ভালো। আমি দেখেছি অনেক মানুষ আছে জীবনে আর কোনোদিন ড্রাইভিংই করতে পারে না। একটা ভয় বা দ্বিধা কাজ করে। আর এ ধরনের কাজে মনের সাহস খুবই প্রয়োজন। কারণ ভীত অবস্থায় ভুল করার সম্ভাবনা একটু বেশি।
এই ট্রমা থেকে ছেলেটির যে ক্ষতিটা হলো, ক্লাসে ও ভালো রেজাল্ট করতে পারল না। এই ট্রমার সঙ্গে যোগ হলো বিফল হওয়ার গ্লানি। কারণ ছেলেটি সবসময় ভালো করেছে। এটা মানতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল। জীবনের এই মুহূর্তটির জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ক্রমেই ছেলেটির মনের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। খারাপ রেজাল্ট থেকে ইয়ার ড্রপ। আরও বেশি গল্গানি। অন্য বন্ধুরা এগিয়ে যাচ্ছে। সে পিছিয়ে পড়ছে। একটা উইথড্রন সিনড্রোম আসে এটা থেকে এবং সেটা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অর্থাৎ একা হয়ে যাওয়া।
বন্ধুহীন জীবন আরও কষ্টের। ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করল ছেলেটি। ডিপ্রেশন থেকে মানুষ শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। ছেলেটিরও তাই হলো। মা তাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার বুঝে গেলেন যে, ছেলেটি মানসিকভাবে খুব হতাশায় ভুগছে। তাই তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে বললেন।
সাইকিয়াট্রিস্ট সব দেখেশুনে ছেলেটিকে ওষুধ খেতে বললেন। সেই ওষুধ খেয়ে তার ১৬-১৭ ঘণ্টা ঘুম হতে শুরু করল এবং বাকি সময়টাতেও তার ফ্রেশ লাগত না, সবসময় একটা ঝিমানো ভাব। তাই ছেলেটা এই ওষুধ একদমই পছন্দ করত না। মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করল। কার ভালো লাগে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতে এবং তার পরও অবসাদগ্রস্ত হয়ে থাকতে? ছেলেটা জীবনটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করল। এই করে দু’বছর পার হয়ে গেল। ছেলেটা দু’বছর পিছিয়ে গেল পড়াশোনাতে। ডিপ্রেশন বাড়তেই থাকল, সেই সঙ্গে আবার যোগ হলো স্কিজোফ্রেনিয়া। কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা।
একদিন বাসা থেকে বের হয়ে ওর আর ভালো লাগছিল না। নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ব্যাগ-প্যাকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল; কিন্তু স্কিজোফ্রেনিয়া থাকাতে ওর কল্পনায় কোনো এক আপনজন এসে, ওর সঙ্গে কথা বলে ওকে এই কাজ থেকে বিরত রেখেছে সেদিন। ছেলেটা পরে নিজেই ওর বাবা-মায়ের কাছে বলেছে, সে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। বাবা-মা শঙ্কিত হয়ে আবার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি আছে বলে এই ছেলেটাকে তখন মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছেন সাইকিয়াট্রিস্ট।
সাত দিন পরে বাসায় নিয়ে আসে; কিন্তু খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আবারও মেন্টাল হসপিটালের শরণাপন্ন হতে হয় তাকে। আবারও কিছুদিন থাকার পর ঘরে ফেরে। কিন্তু কোনোভাবেই ওর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। ছেলেটা বাঁচতে চায় না। তাই ডাক্তারকে ইউথেনশিয়ার কথাও জিজ্ঞেস করেছে- যেন ওকে লিগ্যালি মেরে ফেলা যায়। এমন করে বাঁচতে ভালো লাগে না ওর। নিজের জীবনকে মুক্তি দিতে চায় সে। কিন্তু ইউথেনশিয়া এখনও লিগ্যাল না অনেক দেশেই। ছেলেটার আবারও মন ভেঙে গেল। কিন্তু এই জীবন আর ভালো লাগছে না কিছুতেই।
একদিন ছেলেটা বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাকে একটা টেক্সট করে বলেছে, ওর ঘরের আলমারির দ্বিতীয় ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ দেখতে। এই টেক্সট পেয়ে মায়ের মনে তীব্র হোঁচট লাগে। দৌড়ে গিয়ে সেই ড্রয়ার খুলে দেখেন একটি ‘সুইসাইড নোট’। ‘মা আমি আর এই মানসিক চাপ নিতে পারছি না। আমি চলে গেলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি; কিন্তু এই জীবন আর টেনে নিতে পারছি না।’ মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এলো। খুঁজতে শুরু করল ছেলেটাকে, সবকিছু আটকে পুরো শহর খুঁজেও আর ছেলেটিকে পাওয়া গেল না। সেই নদীতেও তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ডুবুরি লাগিয়ে; কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।
এক মাসেরও বেশি হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত ওর বডি পাওয়া যায়নি। এটাই এখন একমাত্র ভরসা যে, ও হয়তো কোথাও বেঁচে আছে। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে জীবনের এই অত্যাচার থেকে। কিন্তু ওর এই মানসিক অবস্থায় ও কতদিন একা একা বাঁচতে পারবে? বিশেষ করে স্কিজোফ্রেনিয়া থাকাতে এই সম্ভাবনা একটু কমই মনে হচ্ছে; তবুও আশা করতে পারি আমরা। হতেও তো পারে; হয়তো বেঁচে আছে ও কোথাও।
এখান থেকে কি ছেলেটাকে বাঁচানো যেত না? সেই অ্যাকসিডেন্টের পরপরই ওর কাউন্সেলিং দরকার ছিল। ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদেনি বলে বোঝা যায়নি ওর কষ্টের পরিমাণ কতটা বেশি ছিল। একদম প্রথম বয়সের অ্যাকসিডেন্ট, ভয়ও পেয়েছিল নিশ্চয়ই ছেলেটা। অন্যদিকে এই অ্যাকসিডেন্টটা তার জন্য একটা ব্যর্থতা ছিল। কাউন্সেলিং পেলে এখান থেকে হয়তো ফিরতে পারত। এর পরে রেজাল্ট খারাপ করাটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। যে সারাজীবন ভালো করে এসেছে সবকিছুতেই, তার জন্য খারাপ করাটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটা গ্রহণ করার জন্য যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন ছিল সেটার জন্যও কাউন্সেলিং ওকে সাহায্য করতে পারত।
এসব বাদে আরও বেশি যেটা প্রয়োজন ছিল, সেটা হলো শুরুতেই অর্থাৎ একদম ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের হেরে যাওয়াটাকে সহজভাবে নেওয়ার পদ্ধতি শেখাতে হবে। কারণ জীবনে সবসময় জয়ী হওয়া যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জয়ী হওয়া গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না, এটাই বাস্তবতা। সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। হয়ে যায়।
অনেক পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ল। একটা কমিউনিটি পিকনিকে, ছোট-বড় সবাই বেলুন ফুটানোর গেম খেলছিল। খুব আনন্দময় একটা দিন। খেলা শেষে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হলো। এর মধ্যেই একটি ৭ বছর বয়সের বাচ্চার মা এসে বিচারককে অনুরোধ করলেন তার বাচ্চাকে যেন বিজয়ী করা হয়। কারণ সে কাঁদছে। মা হয়ে বাচ্চার এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কীভাবে করতে পারে? বিচারক অবাক হলেও ওই মুহূর্তে মাকে এবং বাচ্চাকে খুশি করল; কিন্তু আমি মনে মনে ভীত হলাম, এই বাচ্চাটা হেরে যেতে শিখল না। ওই মায়ের জন্য ওটা ছিল ‘গোল্ডেন অপরচুনিটি’; কিন্তু মা তা বুঝলেনই না। এখানে এই ৭ বছরের বাচ্চাটিকে দুটি শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল_
১. হেরে যাওয়া জীবনেরই একটি অংশ। এর পরেরবার ভালো করার জন্য চেষ্টা করতে পারে (তাছাড়া কমিউনিটি গেম একটা আনন্দ করার জায়গা, এখানে প্রতিযোগিতাটাই মূল বিষয় না)।
২. মন চাইলেই সবটা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার শিক্ষাটাও জরুরি ছিল (এটার কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণ থেকে শুরু করে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে)।
ফিরে আসি আগের কথায়। খারাপ রেজাল্ট হতেই পারে, স্পোর্টস ডে’তে হারতেই পারে-সেটাতে লজ্জার কিছু নেই। কারণ এটা জীবনেরই অংশ। তাছাড়া হেরে গেলেই বরং নতুন পদ্ধতি শেখার সুযোগ আসে। শুধু জয়ী হয়েছে যারা, তারা জীবনের অনেক শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। বাসায় নিজের সন্তানকে ভালোবাসি বলে মিথ্যা মিথ্যা লুডু খেলাতে জিততে দেওয়া ঠিক হবে না। এটা ভালোবেসে বিরাট ক্ষতি করার শামিল। ঘরের বাইরের জীবন তো বাবা-মা সাজিয়ে দিতে পারবেন না।
সত্য মানতেই হবে, যেখানে জয়ের পাশাপাশি পরাজয় থাকে। বিভিন্ন রকমের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতে পারে মানুষকে; বিভিন্ন রকমের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মানসিক মনোবল খুবই প্রয়োজন। যেন হেরে গেলেও ভেঙে না পড়ে। যত বিপদই আসুক, পরাজয় আসুক আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেন চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।
আর দয়া করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার আগে কাউন্সেলরের কাছে যান, আপনার ওষুধ না-ও লাগতে পারে। তাহলে দিনের মধ্যে ১৬-১৭ ঘণ্টা ঘুমিয়ে হতাশা বাড়াতে হবে না। কাউন্সেলিং সত্যি আপনাকে সাহায্য করতে পারে। সবাই মনের শান্তি খুঁজে পান এই প্রত্যাশায়।
সূত্র: সমকাল