সমন্বিত পরীক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক? - Dainikshiksha

সমন্বিত পরীক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক?

আলী ইমাম মজুমদার |

একটি মহল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য অভিন্ন পরীক্ষাব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকেও এ দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন জানানো হচ্ছে। এটা সত্য, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। তাদের অভিভাবকেরাও ছোটাছুটি করেন, উদ্বিগ্ন থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই নিজ নিজ সুবিধা অনুসারে ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি তৈরি করে। তবে একটির সঙ্গে অপরটি যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সে চেষ্টাও করে। এ দেশে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা আছে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর জন্য। তাদের কোর্স কাঠামো অভিন্ন। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় এই পরীক্ষাব্যবস্থার মানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। তবে এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় তা নয়। আজকের বিষয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ভালো-মন্দ নিয়ে।

সরকারি বাজেট থেকে টাকা নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে, সেগুলোকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। এখন এগুলোর সংখ্যা ৩৭। প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের। চিকিৎসা বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কারিগরি, নৌপরিবহন, বস্ত্র ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে আছে যথাক্রমে ৪, ৯, ৫, ১, ১ ও ১টি বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫টি। এগুলোতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা চলছে। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা, ইংরেজির মতো মানবিক বিষয়াদি এবং সমাজবিজ্ঞান শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অভিন্ন হবে না। গুচ্ছগুলো কীভাবে হবে, তা–ও বিশদভাবে কেউ বলছেন না। এমনটা হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি এবং প্রচুর ব্যয় থেকে রেহাই পাবেন, এটা সত্য। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটি দেশের উচ্চশিক্ষায় কী উপকারে আসবে, সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেউ জোরালো আলোচনা করছেন বলে মনে হয় না।

মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ভিত্তি মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর এবং শিক্ষার্থীদের পছন্দ। কয়েকটি কলেজ উচ্চ আদালতে মামলা করে নিজেদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অধিকার বহাল রেখেছে। অনুরূপ ভিত্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে স্নাতক পর্যায়ে নির্ধারিত হয় কলেজ। বলা সংগত যে বর্তমান পরীক্ষাব্যবস্থার কেরামতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করা একরকম দুঃসাধ্য বিষয়। এর মধ্যেও মফস্বল কেন্দ্রের অনেকগুলোতে নিরিবিলিতে নকলচর্চা চলে। তাদের নম্বর শহরের ভালো ভালো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের থেকে কিছু ক্ষেত্রে বেশি। এমনকি এ ভর্তির কাতারে আছে মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও। তারাও অনেক নম্বর পায়। সুতরাং তারা ভালো ভালো কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। এ রকম স্নাতক স্তরের বেশ কিছু শিক্ষার্থী টাকার অভাবে পড়াশোনা চালাতে না পেরে ছেড়ে দেয়। এ ধরনের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা ভালো স্কুল-কলেজগুলোকে আরও ভালো এবং পিছিয়ে পড়া স্কুল–কলেজগুলোর মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা ব্যাহত করছি।

তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে হবে? শুধু প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষাব্যবস্থার চিন্তা করাও বেশ কঠিন। গাজীপুরে অবস্থিত ডুয়েটে প্রকৌশল ডিপ্লোমাধারীরাই ভর্তি হতে পারে। তাই তারা অভিন্ন ব্যবস্থায় আসবে না। বুয়েটের সঙ্গে অবশিষ্ট তিনটির মানের পার্থক্য সবাই জানেন। এ ধরনের সমন্বিত পরীক্ষা হলে বুয়েট ছাড়াও অপর তিনটিতে তো পরীক্ষাকেন্দ্র হবে। এতে পরীক্ষা গ্রহণের মান অভিন্ন থাকবে কি না, প্রশ্ন থেকে যায়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি তো তাদের কাছেই রাখতে হবে। কৃষি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানও অভিন্ন নয়। ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এর ছাপ পড়তে পারে। আর শুধু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যদি একটি গুচ্ছ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এদের মধ্যে মানের পার্থক্য হবে অনেক বড় রকমের। ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে। আর সাধারণের মতো প্রায় একই ধরনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভিন্ন বলয়ে আনলে পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের বেশ কিছু শিক্ষার্থী সুযোগ পেয়ে যাবে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। আর কিছু ভালো শিক্ষার্থীর খেসারত দিতে হবে। একটি সমস্যা দূর করতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার যে মানটুকু আছে, তা–ও আমরা কমিয়ে ফেলব, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এমনিতেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে নেই। তাও যে দু-চারটি কিছুটা মর্যাদা ভোগ করে, প্রস্তাবিত ব্যবস্থা তাদের প্রতি বৈরিতার নামান্তর হবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে যদি কেউ নির্মোহ গবেষণা করে র্যাঙ্কিং করেন, তবে সেগুলোর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যাবে। সচেতন নাগরিকেরা এ বিষয়ে জানেন। অথচ স্বাধীনতার আগে দেশের গোটা চারেক সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের পার্থক্য এত ব্যাপক ছিল না। সবখানেই উঁচু মানের শিক্ষকেরা ছিলেন। আর এখন! অথচ সব শিক্ষকের পদ-পদবি ও বেতন-ভাতা সমান স্তরের। যেমন বিসিএসের সব ক্যাডার ও সাব-ক্যাডারে। আমরা মুড়ি-মুড়কি আর তেল-ঘি একদর করে ফেলেছি অনেক আগে থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথাতেই যদি আসি, তাহলে বলতে হবে ভারত-পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় যৌক্তিক পার্থক্য রয়েছে। এবারে ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য ভিন্ন বেতন স্কেল দেওয়ার একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বরং উল্টো একটি জট লাগানো হয়। তা খুলতেই অনেক সময় লাগল। এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক বেতন স্কেল নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা কোনো দাবি করেন না। সম্ভবত নিজেদের মধ্যে ‘সংহতি’ বজায় রাখতে তাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবি তেমনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। কিন্তু এর পক্ষে প্রচারণা জোরদারই হচ্ছে। তবে এটা কলেজে ভর্তির বিষয়টি সরাসরি সরকারের বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের মতোই বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কারা পড়বে, তা ঠিক করার অধিকার স্বাভাবিকভাবে সেখানকার শিক্ষকদের হাতেই থাকে। আর ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কত ধরনের কোর্স! এগুলোর শিক্ষার্থীদের উপযোগিতা হবে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। এটাকে সমন্বিত করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি হয়ে যেতে পারে।

সরকার অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, বিনা মূল্যে বই দেওয়াসহ বহুবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সঠিক নীতিকাঠামোর অভাবে ক্ষেত্রবিশেষে এর বিপরীতমুখী ফল দেখা যাচ্ছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলেছি। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনা মূল্যের বই ফেলে রেখে শুধু গাইড বই পড়ানো হয় বেশ কিছু স্কুলে। আর কোচিং তো করতে হয়ই। কোচিং ও গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে সরকারের উদ্যোগ লক্ষণীয়ভাবে নিষ্ফল হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় যেভাবে নম্বর দেওয়া হচ্ছে, তা অনেকটাই একধরনের জোর করে। অথচ এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। মানুষের আর্থিক সংগতি বাড়ার ফলে এবং সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টায় আগের তুলনায় বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। দরকার তাদের ভালোভাবে পড়িয়ে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। বিপরীতে পড়াশোনা যতটুকু হোক, পরীক্ষায় তাদের ঢালাওভাবে নম্বর দেওয়া হচ্ছে। তারা সামনে চলতে গিয়ে এমনিতেই পড়ছে মুখ থুবড়ে। এসব দেখেশুনে অন্তত ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও ভালো করতে অনুপ্রাণিত করা সংগত। যারা খুঁড়িয়ে চলছে, সেখানে ভালো শিক্ষক নিয়োগ ও উপযুক্ত প্রশাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আরও অনেক বাড়াতে হবে। আর ভালো-মন্দ একসঙ্গে মিলিয়ে ফেললে যেটুকু অর্জন হয়েছে, তা–ও যাবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071110725402832