সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির নতুন নিয়ম তাদের কতটা স্বস্তি দিয়েছে? - দৈনিকশিক্ষা

সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির নতুন নিয়ম তাদের কতটা স্বস্তি দিয়েছে?

মাছুম বিল্লাহ |

শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে ’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক বদলি নীতিমালা ঘোষনার সাড়ে তিনমাস পরই আবেরকটি সংশোধিত নীতিমালা জারি করেছে সরকার। মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক কর্র্তত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রেখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদ্যালয়-২ শাখা থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশিক জারি করা হয়। নতুন নীতিমালায় মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের যে কোন সময় সংযুক্তি প্রদানপূর্বক বদলি করতে পারবে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ছাড়া অপর কোন কর্তৃপক্ষ এরুৃপ সংযুক্তির আদেশ প্রদান করতে পারবে না। এ ছাড়া সংযুক্তি আদেশ বাতিলের ক্ষমতাও মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত থাকবে। সংশোধিত নীতিমালায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বদলিসংক্রান্ত একচছত্র ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। নতৃন নীতিমালা অনুযায়ী ইউইওর একক সিদ্ধান্তে নয়, বরং উপজেলা শিক্ষা কমিটির সুপারিশ নিয়ে বদলি করতে হবে। সুপারিশ কার্যকর করবেন ডিপিইও।নতুন নির্দেশিকা জারির ফলে এর আগের সব নীতিমালা , প্রজ্ঞাপন ও আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। সদ্য জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদায়নের ক্ষেত্রেও নতুন নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে। তবে সদ্য জাতীয়করণকৃত এসব বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকদের নামে আদালত কতর্ৃৃক বদলি স্থগিত থাকবে এমন নির্দেশনা থাকলে তিনি বদলির জন্য বিবেচিত হবেন না। সাধারণত প্রতি শিক্ষা বর্ষের জানুয়ারী –থেকে মার্চ মাসের মধ্যে শিক্ষক বদলি সম্পন্ন হয়ে থাকে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তার নিজ অধিক্ষেত্রে একই উপজেলার মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কমিটির সুপারিশক্রমে সহকারী শিক্ষকদের আন্ত:বদলির অনুমোদন দিতে পারবেন। পরে উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার বদলির আদেশ জারি করবেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আন্ত:উপজলো/থানার মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারের সুপারিশক্রমে বদলি করতে পারবেন। সিটি করপোরেশনের আহওতাধীন থানার ক্ষেত্রেও এরুপ বদলি করতে পারবেন। বিভাগীয় উপপারিচালক তার নিজ অধিক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের সুপারিশক্রমে সহকারী শিক্ষকদের আন্ত:জেলা বদলি ও প্রধান শিক্ষকদের একই উপজেলা , আন্ত:জেলা ও আন্ত:জেলা বদলি করতে পারবেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও বিভাগীয় উপপরিচালকের সুপারিশক্রমে যেকোন সময় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের আন্ত:বিভাগ বদলি করতে পারবেন। একইভাবে তিনি সিটি করপোরেশন এলাকাধীন থানার ক্ষেত্রে সুপারিশক্রমে প্রধান শিক্ষকদের আন্ত:থানা/আন্ত:বিদ্যালয় বদলি করতে পারবেন। সর্বোপরি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বার্থে মন্ত্রণালয় যে কোন শিক্ষককে যে কোন কারণে বদলি করতে পারবে।

সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির মেয়াদ ন্যুনতম দুই বছর পূর্ণ হলে ও পদশূন্য থাকলে আন্ত:উপজেলা/থান, আন্ত:জেলা, আন্ত:সিটি কর্পোরেশন ও আন্ত:বিভাগ বদলি করা যাবে। তবে দুই বছরের মধ্যে একই উপজেলায়/থানায় পদ শূন্য হলে বদলি হতে কোন বাঁধা থাকবেনা। এভাবে বদলির এক বছর অতিক্রান্ত না হলে কোন শিক্ষক পুন:বদলির জন্য বিবেচিত হবেন না। প্রধান শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেলে তার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে বদলি যে কোন সময় শিক্ষককে বদলি করা যাবে। তবে এরৃুপ বদলির ক্ষেত্রে নিয়মিত সময়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা/জেলা শিক্ষা অফিসার/বিভাগীয় উপপরিচালকরা নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বদলি করবেন। তবে অন্য সময়ে অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমোদন্ক্রমেই কেবল বদলি করা যাবে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে যে কোন সময় শিক্ষককে বদলি করা যাবে।নীতিমালায় বলা হয় শিক্ষক ছাত্র অনুপাত এবং শ্রেণিকক্ষ-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪০ এর বেশি হলে কোন শিক্ষককে সমন্বয়ের প্রয়োজনে বদলি করা যাবেনা। একইভাবে ৫ বা তার কম শিক্ষক বিশিষ্ট বিদ্যালয় থেকে কোন শিক্ষককে বদলি করা যাবেনা। সমন্বয় বদলির ক্ষেত্রে জেষ্ঠ শিক্ষকদের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জেষ্ঠ শিক্ষকরা বদলি হতে ইচছা পোষণ না করলে কনিষ্ঠদের বদলি করা যাবে। অবসর উত্তর ছুটিতে যাওয়ার এক বছর সময়ের মধ্যে কোন শিক্ষককে সমন্বয়ের প্রয়োজনে বদলি করা যাবে না। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত চালু রয়েছে এরৃপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনে শিক্ষক বদলিপূর্বক সমন্বয় করা যাবে।

নীতিমালায় উল্লেখ আছে প্রশিক্ষণে যাওয়া মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যাওয়াসহ নানা কারণে শিক্ষক স্বল্পতায় পাঠদান বিঘিœত হওয়ার কারণে মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় যে কোন শিক্ষককে যে কোন সময় যে কোন বিদ্যালয়ে সংযুক্তি দিতে পারবে। মন্ত্রণালয় ছাড়া বদলির অপর কোন কর্তৃপক্ষ এমন সংযুক্তি দিতে পারবেনা।নীতিমালায় বলা হয়েছে, চাকরি লাভের পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এমন নারী শিক্ষক স্বামীর স্থায়ী ঠিকানায় বদলি হতে চাইলে শূন্য পদের বিপরীতে বদলি করা যাবে। তবে একটি শূন্যপদের বিপরীতে একাধিক আবদেনকারী থাকলে জেষ্ঠতার ভিত্তিতে বদলি করতে হবে। একইভাবে বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা শিক্ষিকাকে তার পিতার স্থায়ী ঠিকানায় বদলি করা যাবে। নীতিমালা অনুযায়ী, কোন শিক্ষক চাকরিরত অবস্থায় দূরারোগ্য ব্যধিতে ( ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, এইচআইবি পজিটিছ ভাইরাস) আক্রান্ত হলে কিংবা বাইপাস সার্জারি হলে ওই শিক্ষকের চিকিৎসার সুবিধার্থে অনত্র বদলি করা যাবে। তবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এরৃপ বদলি প্রযোজ্য হবেনা। একইভাবে কোন শিক্ষক দুর্গম এলাকায় ( হাওড়, বাঁওর, চর , দ্বীপাঞ্চল) ১০ বছর কর্মরত থাকলে ওই শিক্ষককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শূন্য পদ থাকা সাপেক্ষে একই উপজেলার সুবিধাজনক বিদ্যালয়ে বদলি করা যাবে। ২০১১ সালের ১৯জুলাই জারি করা সর্বশেষ নীতিমালা অনুসারে বদলির একক কর্তৃত্ব ছিল শিক্ষা অধিদপ্তরের ও জেলা শিক্ষা অফিসের হাতে। মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল অনেকটাই গৌন। কিন্তু সংশোধিত নীতিমালায় যে কোন সময় শিক্ষকদের বদলির আদেশ দেয়ার ক্ষমতা ও বিধান রাখা হচেছ মন্ত্রণালয়ের হাতে। এর ফলে শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে শিক্ষক নেতারা। তবে রাজধানী ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ছাড়া অন্য সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও সদর উপজেলায় শিক্ষকদের বদলির সুযোগ অবারিত হচেছ নতুন নীতিমালায়। এটি প্রাথমিক শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি।

সেনা সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান বদলি নীতিমালাটি জারি করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান নির্বিঘœ করার স্বার্থে শিক্ষকদের বদলি প্রতি শিক্ষাবর্ষের জানুয়ারী-মার্চ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে তাতে প্রস্তাবিত বদলি নীতিমালায় ওই তিন মাস ছাড়াও মন্ত্রণালয় বছরের যে কোন সময়কে বদলির জন্য নির্ধারণ করে ও যুক্তসঙ্গত কারণ উল্লেখ করে বদলির কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবে। যুক্তিসঙ্গত কারণের কোন ব্যাখ্যা নীতিমালার কোথাও দেয়া হয়নি। শিক্ষক নেতারা আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপে এখন যে কোন শিক্ষকের বদলির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে তিনজন শিক্ষক দিয়ে পরিচালিত স্কুলগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম ব্যবাহত হবে। দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে ও এর আশপাশে মোট ১১টি সিটি করপোরেশন এবং তিন শতাধিক পৌরসভা রয়েছে। এর বাইরে জেলা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সরকারী প্রায় ৬৪হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে শিক্ষিকার সংখ্যাই বেশি।

থানা শিক্ষা অফিসারদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে এবং শিক্ষক বদলীর একক ক্ষমতা রোধের কারণে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক বদলীর ক্ষেত্রে সংশোধন এনেছে। থানা শিক্ষা অফিসারের একক ক্ষমতা রহিত করে উপজেলা শিক্ষা কমিটির হাতে দেয়া হয়েছে এই বদলীর আদেশ। যেখানে উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ষোল জনের একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। আর এই কমিটির উপদেষ্টা হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অর্থাৎ বিষয়টিকে পুরো রাজনীতিকরণ করা হলো। ফলে সমস্য বেড়ে গেছে বহুগুন।পুর্বে যখন থানা শিক্ষা অফিসার ( টিইও) কাছে বদলির বিষয়টি ছিল তখন শিক্ষকদের এক কাজের জন্য তিন থেকে চার হাজার টাকা ঘুষ দিতে হতো আর এখন নাকি সেই ঘুষ বেড়ে হয়েছে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা যা একজন শিক্ষকের পক্ষে যোগান দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তবে কিছু কিছু উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন যারা এসব বিষয়ে খুব একটি মাধা ঘামান না, টিইও-কেই বদলী করতে দেন কিন্তু যেসব উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান এসব ব্যাপারে আগ্রহী সেখানকার শিক্ষকদের অবস্থা চরমে অর্থাৎ পুর্বের চেয়ে দশগুণ বেশি ঘুষ দিতে হচেছ। দ্বিতীয়ত, অনেক কালক্ষেপন করতে হয় কারন এখন একজন শিক্ষককে ষোলজন ব্যক্তির সাথে তার দেখা করতে হয়, খুশী করতে হয় যা পূর্বে ছিল একজন। তাই সমস্যা আরও জটিল আকার ধারন করেছে । সরকার শিক্ষকদের ঝামেলা কমানোর জন্য ও দুর্দশা লাঘবের জন্য এই পরিবর্তন এনেছে কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। এখন সরকারকেই বিষয়টির শান্তিপূর্ন সমাধান বের করতে হবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়]

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003486156463623