সারাদেশের মোট ৩৩৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষকের শূন্য পদ রয়েছে দুই হাজার ৩৬০টি। পাঁচ বছর ধরে এসব বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অবসরে অথবা মারা গেছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য অনুরোধ করা হলেও নিয়োগবিধি গেজেট আকারে জারি না হলে এসব পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে অপারগতা জানিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
পিএসসি থেকে সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদে ৩৪তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে ৪৫০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মাউশি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের মেডিকেল ও পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে। দ্রুত তাদের নিয়োগ করা হচ্ছে। তারপরও সহসাই শিক্ষক সংকট দূর হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গ নিয়োগ বিধিমালা :পাঁচ বছর আগে মাধ্যমিক শিক্ষকদের পদ তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদার হওয়ায় মাউশি নিজস্ব এখতিয়ারেই নিয়োগ দিতে পারত। ২০১২ সালে সরকারি হাইস্কুল শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা ঘোষণা করেন। ফলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা চলে যায় পিএসসির হাতে। পিএসসিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু পিএসসি জানাচ্ছে, নিয়োগবিধি গেজেট আকারে জারি ও প্রকাশ না হলে এসব পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের কাজ আটকে থাকায় শিক্ষক নিয়োগও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জানা যায়, একজন নারী অতিরিক্ত সচিব ও কয়েকজন সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের গোঁড়ামি ও একচোখা মনোভাবের কারণে নিয়োগবিধি ঝুলে রয়েছে।
জানতে চাইলে মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামছুল হুদা বলেন, ‘সরকারি স্কুলগুলোতে মামলা জটিলতার কারণে শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। সারাদেশে দুই হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। তবে সরকার পুরনো নিয়োগবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। নিয়োগ বিধিমালা-২০১৭ নামের বিধি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিধিমালাটি আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
যে চার বিষয়ে শিক্ষক নেই :গত ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কারিকুলাম ও সিলেবাস পরিবর্তন হওয়ায় বিদ্যালয়গুলোতে গত পাঁচ বছরে চারটি নতুন বিষয় চালু হয়েছে। এগুলো হলো_ তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি), শারীরিক শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, চারু ও কারুকলা। এগুলোর জন্যও কোনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে এক বিষয়ের শিক্ষককে পাঠদান করতে হচ্ছে অন্য বিষয়ে। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তির মতো নতুন ও মৌলিক বিষয়ও পড়ানো হচ্ছে অন্য বিষয়ের শিক্ষককে দিয়ে।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. ইনছান আলী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, আবার বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে। ফলে মাধ্যমিকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে তথৈবচ অবস্থা দেখা দিয়েছে।’
এ বিষয়ে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) সাখাওয়াত হোসেন বিশ্বাস বলেন, ‘দ্রুত আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিষয়টির সমাধান হতে যাচ্ছে। ৩৩৩টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন, পাসের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এতে শিক্ষক সংকট কিছুটা কাটবে।’
শূন্য পদ : নিয়োগ বন্ধ থাকায় ৩৩৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মহানগরীর বিদ্যালয়গুলোতে তেমন সংকট না থাকলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট প্রকট। শত শত শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ৪-৫ জন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে সিরাজগঞ্জ কাজী এমইও উচ্চ বিদ্যালয়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়, বান্দারবান রংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চরভদ্রাসন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মহেশখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুতুবদিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক বিদ্যালয়ে।
জানা যায়, ৩৩৩টি বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের পদ ১১ হাজার ৩০টি। এর মধ্যে ১০ হাজার ২৪০টি সহকারী শিক্ষকের পদের এক হাজার ৮১৫টিই শূন্য। অন্যদিকে সহকারী প্রধান শিক্ষকের ৪৬২টি পদের মধ্যে সবক’টিই শূন্য। সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে এ পদগুলো পূরণ করা হবে। ৪৬২টি সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা ৪৩০ জন শিক্ষককে ইতিমধ্যে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তাদের পদায়নের আদেশ জারি করা হবে। এ ছাড়া ৩২৮টি প্রধান শিক্ষকের পদের মধ্যে ৮২টি শূন্য রয়েছে।
লালমনিরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ১২ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী একজনও নেই। চতুর্থ শ্রেণির পাঁচটি পদের মধ্যে মাত্র একজন নাইটগার্ড আছে। জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে স্কুল।
অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ শামছুল হুদা বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন হলে এসব বিদ্যালয়ে নিয়মানুযায়ী তিন হাজারের বেশি পদ সৃষ্টি হবে। সেগুলোতে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও ৩৫তম বিসিএস থেকে প্রায় এক হাজার সাতশ’ শিক্ষক নিয়োগ দিতে মাউশির চিঠির প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পিএসসিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যারা নন-ক্যাডারে সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী, তাদের নিয়োগে সুপারিশ করবে পিএসসি। সেখানেও সাতশ’ থেকে আটশ’র মতো শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে। এর বাইরে ৩৩৩টি আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হলে শিক্ষক সংকট কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’