আকাশ-সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের যুগে মুদ্রিত বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। কমছে পাঠক সংখ্যা। বিষয়টি উদ্বেগের। অন্তত গ্রন্থাগার সংগঠকদের কাছে। এই চিন্তা মাথা থেকে সরছে না। তাই ভাবনা জাগে কী করে মানুষকে গ্রন্থ পাঠে উদ্বুদ্ধ করা যায়। কাজটি অসাধ্য নয়, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। শিশুদের বেলায় এ কাজ অনেকটা সহজ। পরিবার শিশুর আদর্শ পাঠশালা। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বজনদের কাছে শেখে। পরিবারে বই পড়ার অভ্যাস থাকলে শিশুরাও পড়বে, শিখবে। ‘পারিবারিক গ্রন্থাগার আলোকিত পরিবারের প্রতিচ্ছবি’। স্কুলে একাডেমিক গ্রন্থাগার চাই। শিক্ষকরা বই পড়বে। শিক্ষার্থীরাও পড়বে। এভাবেই পাঠক সৃষ্টি হবে। আমরা স্কুলকেই পাঠক তৈরির আদর্শ স্থান বলে মনে করি। সেভাবেই কাজ করি।
১৯৮৫ সালে ‘বেরাইদ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি’র সূচনা। এরপর স্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ‘বেরাইদ গণপাঠাগার’ (রেজি. নং. ঢাকা ০৯) করা হয়। রাজধানীর সাবেক গুলশান হালে বাড্ডা থানার বেরাইদ ইউনিয়নকে ‘পাইলট প্রকল্প’ ধরে কাজ শুরু। আর সারা দেশে পাঠাগার আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি’ (রেজি. নং. গগ্রঅ/ঢাকা ১৮)। দুটি সংগঠনের লক্ষ্য অভিন্ন। একটি স্থানীয়, অন্যটি জাতীয় গ্রন্থাগার নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠান।
মাধ্যমিক স্কুলে গ্রন্থাগার চালু করতে হবে, সেই চিন্তা মাথায়। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় সুযোগটি আসে ১৯৮৬ সালে। মাননীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা ৫, বর্তমানে ঢাকা ১১) আলহাজ একেএম রহমতুল্লাহর স্নেহধন্য হয়ে ঐতিহ্যবাহী বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুল ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) সদস্যপদ লাভ (বিদ্যোৎসাহী) করি। টানা ৬ বছর এই পদে ছিলাম। শুরুতেই স্কুলে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। অবৈতনিক পরিচালকের (গ্রন্থাগার) দায়িত্ব নিয়ে কাজে নামি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করি। একজন শিক্ষককে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর বেশ ক’বছর কমিটিতে যাইনি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ একেএম রহমতুল্লাহর নির্দেশে এবার স্কুল সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি। শুরুতেই গ্রন্থাগারের খোঁজ করি। জানা গেল, রেখে যাওয়া স্কুল গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব বহু আগেই বিলীন। বই-বুক শেলফ কিছু পোকায় খেয়েছে, কিছু লোপাট হয়েছে। রবীন্দ্র রচনাবলী, নজরুল রচনাবলী, ৬ খণ্ডের শাহনামা সব হাওয়া। কাকে দোষ দেব? দুর্ভাগ্য এই জাতির।
২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ৮৯৪টি বই নিয়ে ফের গ্রন্থাগার চালু করি। শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালে মাধ্যমিক স্কুল-মাদ্রাসায় সহকারী গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টি করেন। আমাদের গ্রন্থাগারিক নিয়োগ তারই সুফল। স্কুলে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্ত একাডেমিক গ্রন্থাগার বিকাশ ও পাঠক সৃজনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বর্তমানে বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুলে শিক্ষক ২১ এবং ছাত্রসংখ্যা ৬০৫ জন। গ্রন্থাগারে বই আছে ২ হাজার ১১৮, বুক শেলফ ৫, আলমারি ১, টেবিল ৫, চেয়ার ৭০, ফ্যান ৪, লাইট ৪, ঘড়ি ১ এবং ওয়াইট বোর্ড ১টি। ধারণক্ষমতা ৭০ জনের। আছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ। শিগগিরই এটিকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল গ্রন্থাগারে উন্নীত করা হবে।
সরকারের আরও দুটি শুভ উদোগ- ১. গ্রন্থাগার দিবস : সরকার ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করেছে। সারা দেশে দিবসটি আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হয়েছে।
২. লাইব্রেরি ঘণ্টা : সব মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী রুটিনে লাইব্রেরি ঘণ্টা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমরা ২০১০ সালে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ প্রথম শ্রেণীর রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করি। ২০১৫ সালে ফুলটাইম গ্রন্থাগারিক নিয়োগের পর তা বাধ্যতামূলক করি।
এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি, বেরাইদ গণপাঠাগার ও বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুল।
সৌজন্যে: যুগান্তর