শিক্ষার্থীর প্রতিবাদঐতিহাসিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশের বৃহৎ সব অর্জন এসেছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মিলিত শক্তিতে ভর করে। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই সব গণ-আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর ছিল জনগণের অগাধ আস্থা। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের সময় ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের ডাকা হরতালে সদরঘাটের মাঝিরা বইঠা নিয়ে মিছিলে যোগ দেন। স্বাধীন দেশেও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ ছিল এক কাতারে।
কিন্তু নব্বই-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বাড়তে থাকে। শিক্ষাকে ঢালাওভাবে বাণিজ্যিকীকরণ, জনমুখী মূল্যবোধকে হটিয়ে শিক্ষায় বাজারমুখী চিন্তা ও দর্শনের অবাধ আমদানি, শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে গলা টিপে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ছাত্র ও জনতার মধ্যে ক্রমেই এক সীমানাপ্রাচীরের আবির্ভাব হতে থাকে। তবু ২০০৭ সালের আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের সময় আবারও ছাত্রদের সঙ্গে জনগণের মেলবন্ধন দেখে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্ররা এলাকাবাসীর সাহায্য চাইছেন। কারাগারের জমিতে হল প্রতিষ্ঠার দাবিকে এলাকাবাসী পুরোপুরি সমর্থন করছেন না। তারপরও ২২ আগস্ট বংশালে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট আর জলকামান দিয়ে তাণ্ডব চালালে আশপাশের দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে ছাত্রদের আশ্রয় দেন স্থানীয় লোকজন। বিপরীতে ছাত্ররাও জনগণের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে মাইকে বারবার এলাকাবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনে তাঁদের সমর্থন প্রত্যাশা করেছেন। মূলত ২০ দিনের অধিক এ আন্দোলনের প্রায় ১৫ দিনই তাঁরা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরেই কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাঁদের রাজপথে নামতে হয়।
ছাত্রদের সম্পর্কে গত দুই দশকে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে তার দায় আসলে দলীয় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির। কিন্তু হলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সেই ছাত্ররা নন, যাঁদের ছবি চাপাতি-হকিস্টিক হাতে পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, যাঁরা দিনদুপুরে ডজন খানেক ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে হত্যা করেন। এঁরা সেই ছাত্র, যাঁরা গত ২০ দিনের অধিক আন্দোলনে রাষ্ট্রের বা জনগণের কোনো জানমালের ক্ষতি করেননি। ২০০৯ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি, এ ছাত্রদের ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারে। আরও দাবি করতে পারি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলো আরও বেশি পরিণত ও সুশৃঙ্খল হচ্ছে।
আন্দোলন–সংগ্রামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যতটা সুনাম অর্জন করেছে, আবার ঠিক ততটাই দুর্নামের ভাগীদার হয়েছে এখানকার ক্ষমতাসীন সংগঠনের নানা অপকর্মের বদৌলতে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা পুরান ঢাকার নিরীহ দরজি বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা কিংবা বিভিন্ন সময় নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় এলাকায় আতঙ্কের জন্ম দেওয়ার মতো ঘটনাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকেই কমবেশি মূল্য দিতে হয়। আবার ক্ষমতাসীনদের এসব দৌরাত্মে্যর বিপরীতে বাদবাকি ছাত্রদের তরফ থেকে কোনো জোরালো প্রতিবাদও কখনো চোখে পড়েনি। আর তাই অশুভ শক্তির বিপরীতে বিকল্প শক্তির দৃষ্টান্ত না থাকায় ঢালাওভাবে সব ছাত্রের প্রতি একধরনের জন অসন্তোষ বিরাজ করার বাস্তবতা রয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই চলমান হল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের জড়তা ভেঙে আবারও জনতার কাতারে শামিল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিত্যক্ত জমিতে হল নির্মাণের বিপরীতে বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের প্রশ্নে ছাত্র ও এলাকাবাসীর অবস্থানকে আপাত পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুটো দাবিই কি একই সঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়? ছাত্ররা তো কারাগারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব মেনে সেখানে একটি অংশে জাদুঘর করার দাবি জানিয়েছেনই। এবং এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ই তো সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান। আর জাদুঘর হলে সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকবেই। এ ছাড়া উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মিত হলে তাতেও সব মানুষের যাতায়াত নিশ্চিত করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। সে রকমই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রেও নেওয়া সম্ভব নয় কি? এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও চারুকলা অনুষদ চালু হওয়ার পর থেকে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুরান ঢাকাবাসীকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সরস্বতী পূজার আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও সাধারণ মানুষের ঢল নামে। তাই পুরোনো কারাগারের জমিকে ঘিরে ছাত্র ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি পরস্পরবিরোধী তো নয়-ই বরং পরিপূরক হিসেবে দেখা যেতে পারে। উভয়ের দাবির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সেখানে ছাত্র ও স্থানীয়দের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির সুবর্ণ সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। ছাত্ররা ইতিমধ্যে তাঁদের হাত প্রসারিত করছেন, জনগণ সেই হাতে হাত রাখার অপেক্ষা কেবল।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গত অর্ধযুগের বেশি সময় যে সফল ছাত্র আন্দোলনগুলো সংগঠিত করে আসছেন, তা গোটা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকেই নতুন করে পথ দেখিয়েছে। আশা করব ঐতিহাসিক পুরান ঢাকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কারাগারের জমিতে হল, জাদুঘর ও উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণের দাবি আদায় করে তাঁরা ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি মাইলফলক অর্জন করবেন। আর এ আন্দোলনই বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার ঐক্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
লাকী আক্তার: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।