মেধাবী ছাত্র রাসেল মিয়া। বয়স প্রায় ১৬ । তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে কনিষ্ঠ। জন্মের ৭ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়েছে। মা জয়তন নেছা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। নিজেও দিন মুজুরের কাজ করে সংসারের পাশাপাশি লেখাপড়া চালায় ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের ফুলতলা গ্রামের এই রাসেল।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় এক প্রভাবশালীর সাথে তার চাচাদের জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছে দুই বছর যাবত। জমি সংক্রান্ত ঘটনায় চাচাদের সাথে মেধাবী ছাত্র রাসেলের বয়স ২৮ দেখিয়ে ফুলবাড়ীয়া থানায় মামলা করেন সেই প্রভাবশালী। পৃথক ঘটনা দেখিয়ে একের পর এক ৫টি মামলায় আসামি করা হয় তাকে।
অভাবের সংসার আর মামলার বেড়াজালে আটকে যাওয়া রাসেল চলতি বছর দাখিল পরীক্ষায় ফুলতলা দাখিল মাদ্রাসার বিজ্ঞান শাখা থেকে জিপিএ ৪.০০ পেয়েছে। ভালো ফলাফল করেও একাধিক মামলায় আসামি হওয়ায় রাসেলের কান্না কোন ভাবেই থামছে না। তার মতে ফলাফল ভাল করেও কোন লাভ হলোনা! এখন আর লেখাপড়া করা সম্ভব হবেনা, কারন হিসেবে বলেন, পাঁচটি মামলা চালাবো, না লেখাপড়া ও সংসারের খরচ যোগাব? যে বয়সে ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের আদর যত্নে বড় হয়, সেই বয়সে আমি দিন মুজুর হিসেবে মানুষের কাজ করছি, কোনদিন ভাল একটি জামাকাপড় পরতে পারিনি, ভালো খাবার খেতে পারিনি, রক্তপানি করে টাকা উপার্জন করি, সংসারের খরচের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়েছি বলেই কেঁদে উঠে রাসেল।
ফুলতলা গ্রামের মৃত সোনালী মন্ডলের পুত্র আঃ কদ্দুছ স্ত্রী, তিন কন্য ও এক পুত্র সন্তান রেখে মারা যায় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। তখন রাসেল মিয়ার বয়স প্রায় ৭ বছর। এরপর থেকেই মানুষের কাজ করে সাংসার ও লেখাপড়ার খরচ যোগায়। মাদ্রাসা ছাত্র রাসেলের চাচা রফেজ আলীর সাথে একই গ্রামের প্রভাবশালী মাসুদ মিয়ার সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছে। জমি সংক্রান্ত ঘটনায় সেই চাচাদের সাথে রাসেলকেও ৫ টি মামলায় আসামি করা হয়।
গত বছরের ১০ আগস্ট, ২৮ বছর বয়স দেখিয়ে একটি মামলায় রাসেলকে আসামি করা হয়। পুলিশ অন্যন্যা আসামিদের সাথে রাসেলের বয়স ২৮ বছর দেখিয়েই আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন। অথচ চলতি বছর ফুলতলা দাখিল মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ ৪.০০ পেয়ে দাখিল পাস করে সে। মাদ্রাসার রেজিষ্ট্রেশন কার্ড অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০০১ খ্রিস্টাব্দ। গত ২রা মে রাসেল একটি মামলায় হাজিরা দিতে যায় ময়মনসিংহ আদালতে। মামলার হাজিরা দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে। অথচ ঐদিনের দুপুরের একটি ঘটনায় অন্যান্যদের সাথে রাসেলকে আসামি করে গত ৫ মে ফুলবাড়ীয়া থানায় একটি মামলা করে মাসুদ মিয়া।
রাসেল মিয়া দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, আমার বাবা নেই, মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে, আমি নিজেও দিন মুজুরের কাজ করি। ৪ টি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ও দুটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়েছি। ২ তারিখ আদালতে হাজিরা দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে শুনতে পারি ঐদিন দুপুরে মারামারির ঘটনায় আরেকটি মামলা দিয়েছে আমার নামে। এখনো আমার বয়স ১৬ বছর হয়নি, অথচ ২৮ বছর বয়স দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ।
একাধিক নাম ব্যবহার করে মাদ্রাসা ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে মাসুদ মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে নিরব থাকলেও পরে তিনি বলেন, মামলা লেখেন পুলিশ ও ওকিলরা (এডভোকেট) তারা ভুল করেছে। চলতি বছর দাখিল পাস করেছে সেই মাদ্রাসা ছাত্রের বয়স ২৮ দেখিয়ে মামলা করার বিষয়ে তিনি বলেন, রেজিষ্ট্রেশন কার্ড ও সার্টিফিকেট খুঁজে বের করে পরে মামলা করা যাবে, বলে প্রশ্ন করেন? সব গুলো ঘটনার সাথে মাদ্রাসা ছাত্র রাসেল জড়িত রয়েছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, রাসেলের বাড়ি আর আমার বাড়ি পাশাপাশি, আমার জানামতে সে খুব ভাল ছেলে এবং মেধাবী, প্রতিহিংসামূলক ভাবে তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মামলা গুলোতে বাদী তার একাধিক নাম ব্যবহার করেছে।
রাসেলের মা জয়তন নেছা বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার চালাতে গিয়ে আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করি, আমার নিষ্পাপ, নিরপরাধ শিশু পুত্রটিও মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। অনেক আশা নিয়ে লেখাপড়া করছে, স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া একদিন অনেক বড় চাকুরি করবে। কিন্তু একাধিক মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
এবিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাকিবুজ্জামান তালুকদার কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।