৫০ কোটি টাকার মালিক অধ্যক্ষ, অনুসন্ধানে দুদক - দৈনিকশিক্ষা

৫০ কোটি টাকার মালিক অধ্যক্ষ, অনুসন্ধানে দুদক

হায়দার আলী |

ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনার পাড়ের মহাকালী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. জিয়াউদ্দিন শাকির। শহরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন তিনি। এমনকি ১১টি দলিলে প্রায় ১২ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক শাকির। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই সঙ্গে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করেছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন।

দুদক ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ শাখা থেকে আলাদাভাবে বেতন নিতেন অধ্যক্ষ জিয়াউদ্দিন শাকির। ভুয়া রসিদ বানিয়ে নিজেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সই জালিয়াতি করেও আত্মসাৎ করেছেন ৫০ লাখ টাকা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসা সরকারি অনুদানের টাকাও আত্মসাৎ করেছেন। পরিচালনা কমিটির হস্তক্ষেপে ১০ লাখ ফেরতও দিয়েছেন অধ্যক্ষ শাকির।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থেকে জিয়াউদ্দিন শাকির অবৈধভাবে অধ্যক্ষ হয়েছেন জানিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য শিক্ষক প্রতিনিধি প্রভাষক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থেকে নিজের নিয়োগ নিজেই দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।’ আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ ভুয়া রসিদ বানিয়ে টিউশন ফি আত্মসাৎ করেন এবং ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লাখ লাখ টাকায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। দুর্নীতি করে এখন তিনি প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

একজন শিক্ষক হয়ে কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন অধ্যক্ষ শাকির—এ বিষয়ে পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য মো. গিয়াস উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে ডিসি এবং দুদক তদন্ত করছে।’

পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদিক হোসেন বলেন, ‘অধ্যক্ষ শাকির প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি জায়গা থেকে বেতন নিতেন; যেমন—স্কুল শাখা, কলেজ শাখা, ভোকেশনাল শাখা, কারিগরি ও বিএম শাখা থেকে আলাদাভাবে বেতন নিতেন তিনি। সেটা আমি বন্ধ করেছি। এখন এক জায়গা থেকে বেতন পান।’ তা ছাড়া অধ্যক্ষের আত্মসাৎ করা ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান সাবেক সভাপতি।

পরিচালনা কমিটির আরেক সদস্য বলেন, অনিয়ম করে নিজের শ্যালিকাকে নিয়োগ দেওয়াসহ নানা অনিয়ম করে যাচ্ছেন অধ্যক্ষ শাকির।

কলেজ স্টাফ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম মো. হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওনার (অধ্যক্ষ) দুর্নীতির বিরুদ্ধে শহরে আন্দোলন করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের আন্দোলনের কারণে দুর্নীতির ১০ লাখ টাকা ফেরত দিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। কলেজ শাখার ৩০ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৮ জনই তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি।’

১১ দলিলে ১২ কোটি টাকার জমির মালিক : ময়মনসিংহ শহরের বিটিবি সেন্টারের পাশের আকুয়া মৌজায় ১০৫৪৬ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ১৩ শতাংশ জমি কেনেন অধ্যক্ষ শাকির। ওই জমির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া আকুয়া মৌজায় ৬৬৪৩ নম্বর দলিলে সাড়ে ৬ শতাংশ, ৯৬১৪ নম্বর দলিলে সাড়ে ১২ শতাংশ জমির মালিক তিনি।

শহরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশের কিসমত মৌজার তিনটি জায়গায় তিনটি দলিলের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ জমি কিনেছেন শাকির। এর মধ্যে ৩৫৪১ নম্বর দলিলে ৪২ শতাংশ, ৫৯৪১ নম্বর দলিলে ২ শতাংশ এবং ৭৬৬০ নম্বর দলিলে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমির বাজারমূল্য শতাংশপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।

এ ছাড়া শহরের বাইপাসের পাশে ছত্রপুর মৌজায় ৬৮৪৩ নম্বর দলিলে ২০ শতাংশ এবং চর ঈশ্বরদিয়া মৌজায় ১৬৭৮ নম্বর দলিলে ৮৬ শতাংশ জমি কিনেছেন শাকির।

২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে সাড়ে ৪ শতাংশ জমি ৫০ লাখ টাকায় কেনেন শাকির। বায়না দলিলে ৫০ লাখ টাকা দাম দেখানো হলেও ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাব কওলা দলিলে ২৭ লাখ টাকায় রেজিস্ট্রি করে নেন তিনি।

যেভাবে অধ্যক্ষ : মহাকালী গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৭ সালে। এরপর ১৯৯৫ সালে এটি কলেজে উন্নীত হয়। আগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রওশন আজাদকে হটিয়ে ২০০১ সালে নিজেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন শাকির। পরে তিনি ওই পদে থেকেই নিজেকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যক্ষ নিয়োগ নীতিমালায় উল্লেখ আছে—কেউ অধ্যক্ষ হতে হলে অন্তত ১২ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে। কিন্তু শাকির মাত্র তিন বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই জোর করে কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে যান।

উল্টো মামলা : অধ্যক্ষ শাকিরের অনিয়ম এবং জালিয়াতির বিষয়ে জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি সরেজমিন তদন্ত করতে গেলে উল্টো জেলা প্রশাসক ও তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে মামলা করে দেন শাকির।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত কমিটি করে দেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি চিঠি পাঠানো হয় অধ্যক্ষকে। কিন্তু সেই চিঠি পাওয়ার পর অধ্যক্ষ আদালতে মামলা করে দেন।’

দুদকের অনুসন্ধান : অধ্যক্ষ শাকিরের জালিয়াতির বিষয়টি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনকে। অনুসন্ধান শেষে শাকিরের নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, অল্প সময়ে বিশাল সম্পত্তির মালিক হওয়ার তথ্য-প্রমাণাদি পেয়ে মামলার অনুমতি চেয়ে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে।

আত্মসাৎ করা টাকার আংশিক ফেরত : কলেজের টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ২০১৪ সালের শেষ দিকে কলেজ শাখার ২৮ জন শিক্ষক সর্বসম্মতভাবে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদিক হোসেনের কাছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে সভাপতি নিজেই তদন্ত করে জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পান। ওই সময়ে অধ্যক্ষ শাকির বাধ্য হয়ে ১০ লাখ ২৪ হাজার টাকা কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেন।

কিন্তু শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, ১০ লাখ টাকা ফেরত দিলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধ্যক্ষ প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করেছিলেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসা অনুদানের প্রায় ১৪ লাখ এক হাজার ৩৮২ টাকা আত্মসাৎ করেন শাকির।

অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বক্তব্য : অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ মো. জিয়াউদ্দিন শাকির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। প্রতিষ্ঠানটির কিছু শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’ দুদক এবং জেলা প্রশাসকের তদন্ত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি উল্টো আদালতে মামলা করেছি। আশা করছি তদন্তে কিছু পাওয়া যাবে না।’ ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক পরিশ্রম করেই এসব সম্পদ করেছি। এখানে দুর্নীতির কোনো টাকা নেই।

সূত্র:  কালের কন্ঠ।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063579082489014