​ক্যাম্পাস সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও অপরাধীদের আস্ফালন - Dainikshiksha

​ক্যাম্পাস সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও অপরাধীদের আস্ফালন

লুৎফর রহমান সোহাগ |

বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর অন্যতম সাংবাদিকতা। বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকরা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর মাত্রা আরও বেশি, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন। নানামুখি চাপ মোকাবিলা করে এসব নবীন সাংবাদিকদের টিকে থাকতে হয়। অতি সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন সাংবাদিক মারধরের শিকার হয়েছেন। অপরাধীরা এভাবেই পেশীশক্তির দাপটে সাংবাদিকের টুটি চেপে ধরতে চায়।

দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই মূলধারার সিংহভাগ গণমাধ্যমেরই প্রতিনিধি রয়েছে। সঙ্গত কারণেই এসব সাংবাদিকদের বাস্তবতাকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে হবে। অধিকাংশ ক্যাম্পাস সাংবাদিকই নামেমাত্র বেতনে কাজ করেন, অনেককে আবার বেতন ছাড়াই কাজ করতে হয়। ফলে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থী কেবল অর্থোপার্জনের জন্য এ পেশাকে বেছে নেয়নি। কোন মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই তারা এ পেশায় জড়িয়েছে।

অবস্থানগত কারণে এ সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। কারণ যে ক্যাম্পাসের ভাল-মন্দ নিয়ে তারা সংবাদ প্রকাশ করেন, সে ক্যাম্পাসেই তাদের থাকতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অপরাধ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনগুলো তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ এসব নিউজের কেন্দ্রে থাকেন হয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কোন নেতা, না হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা শিক্ষকদের কেউ। এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নানা সময়ে অসংখ্য সাংবাদিকের নির্যাতিত হওয়ার খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিনের ব্যবধানে দুজন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। গত কয়েকমাসে একই ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের হাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিবিদ্যালয়ে কয়েকজন সাংবাদিক মারধরের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় স্পষ্ট যে, সাংবাদিকদের প্রতি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্দ থাকেন। আর সে ক্ষোভের কারণ যে সংবাদ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই পেশীশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সাংবাদিককে ভয় দেখাতে চান, যাতে করে কেউ তাদের কর্মকা-ের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার সাহস না করে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় সাংবাদিকরা বিচার পেয়েছেন খুবই কম। এর একটাই কারণ হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও প্রত্যাশা করে সাংবাদিকরা চাপের মধ্যে থাকুক। তাদের ভূমিকা হোক কেবল প্রশাসনের ইতিবাচক প্রচারণা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সাংবাদিকদের উপর কতটা আগ্রাসী হতে চায়, তার একটি নির্লজ্জ উদাহরণ পাওয়া যাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির শাহ মাখদুম হলের প্রাধ্যক্ষের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় একজন সাংবাদিকের রুমে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই সাংবাদিকের মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে বের করে দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। একজন শিক্ষকের কতটা নৈতিক অধ:পতন ঘটলে তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন তা কল্পনা করাও কঠিন। গণমাধ্যম কর্মীদের উপর শিক্ষকদের চাপ প্রয়োগের এমন অনেক ঘটনা বিভিন্ন ক্যাম্পাসেই অহরহ ঘটছে। কারণ, শিক্ষকরা নিজেদের দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবতে চান, তাদের অনিয়ম নিয়ে নিউজ করা যেন সাংবাদিকের জন্য অপরাধের শামিল।

ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোন শিক্ষকের অনিয়ম নিয়ে তথ্য জানতে চাইলেই তাদের প্রথম প্রশ্ন হয়- আপনি কোন বিভাগের শিক্ষার্থী? উদ্দেশ্য একটাই, ছক মেলানো। ওই বিভাগে পরিচিত কোন শিক্ষক থাকলে তার মাধ্যমে সংবাদটি বন্ধ করে দেয়া, আর তাতে সফল না হলে সাংবাদিককে নানাভাবে হয়রানি করা। এমন অনেক সাংবাদিককে দেখেছি, যারা সত্য ঘটনা তুলে ধরে একাডেমিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীর সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত যৌন হয়রানির অভিযোগসহ অন্যান্য বিষয়ে একজন সাংবাদিক নিউজ করেছিলেন। এরপর ওই সাংবাদিককে তার বিভাগের একজন শিক্ষক ফাইনাল পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে শাসিয়েছিলেন। কিছু শিক্ষকের চরিত্রে একটু সমস্যা থাকেই, তা নিয়ে নিউজ করতে হবে কেন- একজন শিক্ষকের এমন বক্তব্যেই বোঝা যায় তারা গণমাধ্যমকে কতটা নিজের স্বার্থে কুক্ষিগত করে রাখতে চান। আবার অন্যদিকে নম্বরের ভয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও কোন সাংবাদিক তার বিভাগ সংক্রান্ত নিউজ করার সাহস পান না।

এতসব ঝুঁকির মধ্যে কাজ করার পর একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক তার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশা করতেই পারেন। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ওই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেই আরও অনেক শত্রুর দেখা মিলে ওই সাংবাদিকের জন্য। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, কখনো কখনো ছাত্রনেতারা তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠদের খুঁজতে থাকেন। আর যদি সেই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিটি তারা খুঁজে পান এবং তিনি যদি অফিসের প্রভাবশালী কেউ হয়ে থাকেন; তাহলে ওই ক্যাম্পাস সাংবাদিকের চাকরি টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। আমার নিজেরই এমন কয়েকজন সাংবাদিককে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে, যারা সত্য নিউজ করেও কোন অপরাধীর ফোনে চাকরি হারিয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রভাবশালীদের ব্যক্তিপ্রীতির কারণে অনেক সাংবাদিককে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন করতেও দেখেছি। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচিত বিষয়ে এমনও দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ফোন দিয়ে সাংবাদিককে একজন অপরাধীর পক্ষে নিউজ করতে বলেছেন। ফলে তথাকথিত ওই সাংবাদিকদের এই যে দাসত্ব, তা আজ ক্যাম্পাস সাংবাদিকদেরও গ্রাস করছে। ২০১৪ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাংবাদিকের নামে একটি মিথ্যা মামলা হয়েছিল। ওই মামলার আসামির তালিকায় তৎকালীন দৈনিক বর্তমানের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি সুব্রত ম-লের নাম ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রোশে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি তাকে জড়িয়ে নিউজ করে ফেললেন। ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত নিউজটিতে বলা হয়, সুব্রত মন্ডল ওই মামলার আসামি। সুব্রত তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, খবরটি দেখেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার প্রশ্ন ছিল, এই সংবাদ দেখার পর তার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক বাবার অনুভূতি কি হবে। পরে আমি নিজে ওই পত্রিকার বার্তা সম্পাদককে ফোন দিয়েছিলাম, তার উত্তর নিউজটি তো প্রিন্টে যায়নি। ওই সাংবাদিকের দায়িত্বহীন এমন বক্তব্যের মতই আজও ওই ভুল সংবাদটি তাদের ওয়েবসাইটে দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতার দলিল হিসেবে রয়ে গেছে।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে তরুণরা সাংবাদিকতার মত কঠিন পেশায় এসেছেন, ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা তাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। প্রতিনিয়তই অপরাধীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তাদের টিকে থাকতে হয়। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে গেলে অবশ্যই সে সাংবাদিক সফল হবেন। তার এই পথচলায় অপরাধীরা নানা ভাবে বাঁধা সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীরা তার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না; এটুকু প্রত্যাশা থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055968761444092