‘ভাই যে আমার জগন্নাথের অক্টোবরের স্মৃতি
তাদের পুণ্য নামে সবাই গাইছে শোকের গীতি।
পড়তে গিয়ে প্রাণ হারালো আমার যেসব ভাই
কেমন করে ভুলব তাদের ভোলার সুযোগ নাই
আর কতকাল করব লালন শোকের সংস্কৃতি।
ছাদ শুধু নয় ভাঙলো সেদিন সমাজ-দেহের খাঁচা
প্রতিবাদে রক্ত দিল হয়নি যে তাই বাঁচা।’
তপন বাগচির এ কয়টি লাইন জানান দিয়ে যায় শোকাহত সেই দিনটির কথা। দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর। শরতের এলোমেলো হাওয়ায় হালকা বৃষ্টিভেজা দিন। সন্ধ্যায় নামে ঝিরঝির বৃষ্টি। মেঘলা সন্ধ্যার মন খারাপ করা সময়টায় একে একে আসছে অনেকে, ঢুকছে মিলনায়তনে। কেউ শিক্ষার্থী, কেউবা অতিথি। সারি সারি চেয়ারে বসেছে সবাই। জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ পেছনে কিংবা দরজার পাশে দাঁড়ানো। দৃষ্টি সবার বিটিভির পর্দায়। সবেমাত্র বাংলা সংবাদ শেষ হল। বিজ্ঞাপন হচ্ছে। প্রায় চারশ’ মানুষ যে যার মতো জায়গা করে নিয়েছে অনুদ্বৈপায়ন ভবনে, জগন্নাথ হলের পূর্ব-দক্ষিণ পাশের পুরনো ১৯২৫ সালে নির্মিত তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ ভবন, অ্যাসেম্বলি হলে। একটু পরেই শুরু হবে মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় সিরিজের নাটক ‘শুকতারা’। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা ৩০ মিনিট। শুরু হয়েছে নাটকের আজকের পর্ব। সবাই নিঃশব্দ। চোখ নিবদ্ধ ওখানে। আর বাইরে তুমুল বৃষ্টি, দমকা হাওয়া। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে। কাঁটাটা যখন ৮টা ৪৫ মিনিটের ঘরে, তখনই অকস্মাৎ সেই দুর্যোগ নেমে এলো ভবনটিতে।
বিকট আওয়াজে ধসে পড়ল জরাজীর্ণ এস্বেস্টজের ছাদ। নিমিষেই নিভে গেল ৩৪টি তাজা প্রাণ। পরবর্তী সময়ে আরও ৬ জন হারিয়ে গেল চিরতরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আহত হল তিন শতাধিক। পরের দিন দৈনিক পত্রিকাগুলোয় মর্মান্তিক ঘটনার বিস্তারিত দেখে সারা দেশের মানুষ কেঁদেছে। ঘটনার দিন তো ঢাকা শহরের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এসেছিল হল প্রাঙ্গণে, আকুলিত হদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আহতদের প্রাণ বাঁচাতে, বিনা দ্বিধায় রক্ত দিয়েছিল হাসপাতালে। ঠিক মুক্তিযুদ্ধের মতো সবাই এক হয়ে এই দুর্যোগকে মোকাবেলা করেছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা আর অব্যবস্থাপনার প্রতি ক্ষোভ দেখানোর পাশাপাশি অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা, যা আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে। যেমনটি হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব গণ-আন্দোলনের সময়ে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, তেমনটি আমরা দেখতে পেয়েছি জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির সময়ে। নতুন স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবগাহিত সর্বস্তরের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে, সংহতি ও সহমর্মিতার যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সেদিন স্থাপন করেছিল তা চিরকাল বাংলাদেশের সবাইকে, প্রজন্মের পর প্রজন্মেকে সাহস জোগাবে।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং সিনেট সদস্য। থাকি সেন্ট্রাল রোডে। টিভিতে খবরটি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। খবরাখবর নিতে থাকলাম সহকর্মীদের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল আরও একটি বিশেষ কারণে। জগন্নাথ হলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ঢাকার প্রবাসী জীবনের প্রথম দিনটি। ১৯৬৮’র জুনের সম্ভবত প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন লাকশাম রেলওয়ে জংশন থেকে প্রথমবারের মতো ট্রেনে চাপলাম ঢাকার উদ্দেশে। লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে। বয়স মাত্র আঠারো। শহর সম্বন্ধে শুধু কেতাবি ধারণা। পরিচিত কেউ ঢাকায় থাকে না। তাই অচেনা শহরে কোথায় থাকব, কার কাছে যাব, কিছুই জানা ছিল না। শুধু জানতাম আমার এক চাচাতো মামা পড়েন দর্শন বিভাগে, থাকেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। ব্যস্, এটুকুই। বিকালের দিকে পৌঁছলাম কমলাপুর রেল স্টেশনে। দুরু দুরু বুকে উঠলাম একটি রিকশায়। সলিমুল্লাহ হলের ঠিকানাও জানি না। মনে পড়ল জগন্নাথ হলে থাকেন আমার হাইস্কুলের একজন শিক্ষক, উমেশ রায় চৌধুরী, বুককিপিংয়ের শিক্ষক ছিলেন, অমায়িক মুখটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। তাই রিকশাচালককে জগন্নাথ হলে যেতে বললাম। মনে পড়ে, হাইকোর্টের কাছে এসে রিকশাচালক রাস্তার একজনকে জিজ্ঞেস করে, জগন্নাথ হল কোথায়? আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। ঠকবাজ লোকের পাল্লায় পড়লাম নাতো! যাহোক, অবশেষে পৌঁছলাম জগন্নাথ হলে। গেটে উমেশ বাবুর নাম বলতেই দারোয়ান চিনল। আমি উনার কক্ষে গিয়েই পেয়ে গেলাম। বিশাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখানেই আমার দিন বাস (রাত্রি বাস নয়)। পরের কাহিনী অন্য কিছু; এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমার ঢাকা শহরের জীবন শুরু এই জগন্নাথ হল থেকে। তাই স্মৃতিতে সবসময় এ হলটি অমর। অভাবনীয় দুর্ঘটনাটির খবর শুনে তাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম।
মনে হল, এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। ছাত্র-হলের মিলনায়তনে থাকে নিত্যদিন শত শত ছাত্রের আনাগোনা; এটি টিভি দেখা, লুডু খেলা আর আড্ডা মারার জায়গা। সেখানে কেন এত অবহেলা। জেনেছি, হলের প্রভোস্টরা বহু তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওই ভবনটির সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ দেশে এমনই হয়। ঘটনা ঘটে গেলে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। অধিকাংশ কর্তাব্যক্তিই প্রো-অ্যাক্টিভ নন, বরং চরমভাবে রি-অ্যাক্টিভ। আর এতেই প্রাণ যায় নিরীহদের। অনেক জায়গাতেই একই অবস্থা। মনে পড়ে, ১৯৯৭ সালে আমি প্রথম মেয়াদে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট। প্রথম দিনে হল ঘুরতে গিয়েই দেখি, অডিটোরিয়ামটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। অথচ ছাত্ররা এখানেই টিভি দেখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে। একদিন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও মাননীয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি হিসেবে একটি অনুষ্ঠানে এই অডিটোরিয়ামে উপস্থিত থাকা অবস্থায় ভবনটির হাল দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি। প্রকৌশল বিভাগ কত যে বাহানা দেখাল তা এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় মেয়াদে থাকার সময় পর্যন্ত অডিটোরিয়ামটি ভেঙে নতুন করে তৈরি করাতে পারিনি। ব্যর্থ আমি, ব্যর্থ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আসলে দু’এক জনে কোনো শুভ উদ্যোগ নিলেও যারা প্রতিষ্ঠানের উঁচুস্তরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন তারা যদি সে উদ্যোগের অংশীদার না হতে চান, তাহলে উদ্যোগটি মাঠে মারা যেতে বাধ্য। তা-ই হয়, হচ্ছেও সর্বত্র। আর খেসারত দেয় অন্যরা।
জগন্নাথ হলের সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সময়ে কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে, আমি মনে করি, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রতিবছর রুটিনমাফিক নিয়মিত প্রতিটি ভবন পরিদর্শন করা, প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ সঙ্গে সঙ্গেই সম্পন্ন করে ফেলা, প্রকৌশল বিভাগের মতামতকে মাথায় রেখে কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব বিবেক কাজে লাগানো। সর্বোপরি, নির্দিষ্ট কাজটি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা প্রায় প্রত্যেক দিন মনিটর করা। যদি এমনটি হয়, আমাদের আর জগন্নাথ হলের করুণ ট্র্যাজেডি দেখতে হবে না। কোনো মায়ের বুক খালি হবে না, ভাইয়ের অনাকাক্সিক্ষত অকাল প্রয়াণে কোনো বোনের অশ্রু দেখতে হবে না। মা-বাবার আর্তনাদে আলোয় ভরা আকাশ মুহ্যমান হবে না।
এখনও ভূমিকম্প হলে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখলে সে রাতটির কথা মনে পড়ে। অনেক সময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। উৎকণ্ঠা কাজ করে হৃদয়ের মধ্যখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ডরমিটরিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আগেই সংস্কার করা জরুরি। সময় থাকতেই সজাগ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমার পুরো জীবনের প্রায় ৭০ ভাগ সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছাত্র হিসেবে ৬ বছর, শিক্ষক হিসেবে ৪০ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে কার্জন হল পর্যন্ত প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে মিশে আছে নানা রঙের স্মৃতি। আমি চাই না, কোনোভাবেই কামনা করি না যে, আর কোনো দুঃস্বপ্নময় ‘অক্টোবর’ ফিরে আসুক আমার প্রাণপ্রিয় এ প্রতিষ্ঠানে কিংবা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অক্টোবর ট্র্যাজেডির শিকার সবাইকে উদ্দেশ করে বলছি, ‘স্মরণের আবরণে মরণেরে রাখি ঢাকি। মরণসাগরপারে তোমরা অমর, তোমাদের স্মরি।’
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট; উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: যুগান্তর