বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ 'এনটিআরসিএ' কে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করার ইচ্ছে ছিলো না। তদুপরি তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে হয় এ কারণে যে সম্প্রতি একটি বড়সড় নিয়োগের সুপারিশ করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষক সংকটের আপাত একটি সমাধানের পথ তারা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষক নিয়োগের যে সুপারিশ তারা করেছে ভালোয় ভালোয় সে সব নিয়োগ দেয়া গেলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনন্দিন পাঠদান কার্যক্রম গতিশীল হবে তাতে সন্দেহ নেই।
যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেবার জন্য সুপারিশ পেয়েছে তারা এখন খুবই উজ্জীবিত। একাডেমিক বছরের একদম শুরুর দিকে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেবার সুযোগ পেয়ে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। এনটিআরসিএ যাদের নিয়োগের জন্য সুপারিশপত্র পাঠিয়েছে তারা অনেকেই মেধাবী এবং সর্বশেষ কারিকুলাম ও সিলেবাসের সাথে পরিচিত। তারা নিবন্ধন পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। নিবন্ধন পরীক্ষা এখন কোনোভাবে বিসিএস'র চেয়ে কম কঠিন নয়। সে পরীক্ষার মেধাক্রম অনুসারে তাদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। কোনোরূপ অনিয়ম না হয়ে থাকলে নিবন্ধন পরীক্ষা পাস করে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার পথ এখন থেকে উন্মুক্ত। তবে এ জন্য শিক্ষকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে। এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশ' টাকা চিকিৎসা ভাতা দিয়ে আর যাই হউক মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় ধরে রাখা কঠিন হবে। এ সত্য কথাটি অনুধাবন করতে যত বিলম্ব হবে আমরা তত ক্ষতির সম্মুখীন হবো। আমাদের শিক্ষায় দীনতা কোনোদিন ঘুচবে না।
যাই হোক, যারা নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন বিশেষ করে গত তিন-চারটা ব্যাচের নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় সকলেই স্ব স্ব বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স পাস এবং তাদের রেজাল্টও অনেক ভালো। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা দক্ষ ও পারদর্শী। অনেকেই বয়সে তরুণ। চেতনাদীপ্ত যৌবন তাদের। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। যিনি যে বিষয়ে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন তিনি সে বিষয়ে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারবেন বলে অনেকের বিশ্বাস । বিশেষ করে এ নিয়োগের ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজির মতো বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে তাদের পেশাগত বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সটা সম্পন্ন করাতে পারলে এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিলে তারা সবাই মানসম্মত শিক্ষক হয়ে উঠবেন সে আশা করতেই পারি।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক কত যে প্রয়োজন সে আমরা গত ক'বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কয়েক বছর ধরে নিয়োগ এক রকম বন্ধ থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান চরম শিক্ষক সংকটে পড়েছিল। তদুপরি, কোনো কোনো জায়গায় কমিটির হাতে নিয়োগের সময় রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে যাওয়ায় বেশ ক'বছর ধরে শিক্ষক সংকট ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এ দু'টো বিষয় মারাত্মক আকার ধারণ করে আছে।
এনটিআরসিএ'র সাম্প্রতিক উদ্যোগের কারণে অন্তত এ সমস্যাগুলোর কিছুটা হলেও সমাধান হবে। সে কারণে এনটিআরসিএ কে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়। এনটিআরসিএ’র উদ্যোগটি যেন সব সময় চলমান থাকে সে বিষয়ে সবিনয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করি। অন্তত বছরে একবার করে হলেও তারা যদি এ কাজটি করে তবে দেশ ও জাতির অনেক উপকার হবে।
কিন্তু জানিনে এবারের নিয়োগটি কতটুকু সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারবে? সম্প্রতি এনটিআরসিএ যাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে তাদের অনেকের নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান এনটিআরসিএ'র কাছে ই-রিকুইজিশন প্রেরণের সময় নিজের প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত না হয়ে চাহিদা পাঠিয়েছেন। স্ট্যাফিং প্যাটার্ন যথাযথ ফলো করলে সে সমস্যা হবার কথা ছিলো না। আবার অনেকে এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০১৮ অনুসরণ করে রিকুইজিশন পাঠিয়েছেন। উক্ত জনবল কাঠামো বর্তমান নিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকর কিংবা প্রযোজ্য নয়। এনটিআরসিএ কথাটি আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি খেয়াল করেননি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সুপারিশকৃতদের নিয়োগ দেয়া অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের কথা জানি যাদের রেগুলার ম্যানেজিং কমিটি কিংবা গভার্নিং বডি নেই। অনেক জায়গায় কমিটি নিয়ে কোর্টে মামলা। এসব প্রতিষ্ঠানে সুপারিশকৃতদের কে নিয়োগ প্রদান করবে?
অনেকে নন এমপিও পদকে এমপিওভুক্ত দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান 'এমপিও দাবি না করার শর্তে' খোলা শাখা শিক্ষকের পদটি এমপিওভুক্ত পদ গণ্য করে রিকুইজিশন পাঠিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেবার সুপারিশ পেয়েছেন। ভালো কথা। নিয়োগ না হয় দিয়ে দিলেন। এমপিও কে দেবে? এনটিআরসিএ তো সাফ বলে দিয়েছে এমপিও’র দায় তারা নেবে না। সব মিলিয়ে নানা কারণে অনেকের নিয়োগ হবে না কিংবা অনেককে নিয়োগ দেয়া যাবে না। এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে নানান ঝামেলা হবে। এভাবে সুপারিশকৃত অনেক নিবন্ধনধারীর উচ্চাশা যেমন অংকুরে বিনষ্ট হয়ে যাবে তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব লেগেই থাকবে।
আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করা একান্ত প্রয়োজন মনে করি। সুপারিশকৃত বেশিরভাগ শিক্ষক নিজ জেলার বাইরে বাড়ি থেকে অনেক দূরে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তাদের থাকা খাওয়ার নানা সমস্যা হবে। মূলত বাড়িভাড়া একেবারে নগণ্য বিধায় তাদের সীমাহীন কষ্ট ভোগ করতে হবে। এক সময় গাঁও-গেরামে মানুষ শিক্ষকদের লজিং দিতো। এখন কোচিংয়ের অবাধ সুযোগের কারণে অনেকে লজিং দেবার ঝামেলা পোহাতে চান না। শিক্ষক লজিং দেবার পরিবর্তে সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবশ্য কোচিং বন্ধে সরকার খুবই আন্তরিক। কিন্তু জানিনে কোচিং আদৌ বন্ধ হবে কিনা? নোট-গাইড ও কোচিংয়ের অভিশাপ থেকে আমাদের শিক্ষা কোনোদিন রেহাই পাবে সে কেবল আল্লাহ মাবুদই জানেন।
অন্যদিকে আজকালের তরুণ শিক্ষিতরা লজিং থাকার চেয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে কিংবা মেস করে থাকতে পছন্দ করেন। এসব বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সরকারি শিক্ষকদের মতো পুরো বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করা না হলে কষ্ট কেবল বৃদ্ধিই পাবে। বদলির জন্য নতুন নীতিমালা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ নীতিমালায় বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি সরকারিদের ন্যায় নির্ধারণ করা উচিৎ। তাহলে নতুন নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃতরা দেশের ভেতর যেকোনো জায়গায় গিয়ে শিক্ষকতা করতে পিছপা হবে না। পুরনোরাও বদলি হতে কিংবা বদলি নিতে উৎসাহ বোধ করবেন। যেকোনো পেশায় বদলি থাকা একান্ত অপরিহার্য। তাই বদলি এবং পুরো বাড়ি ভাড়া দু'টোই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাণের দাবি।
এনটিআরসিএ কে বিনয় করে আরেকটি কথা বলি। শিগগিরিই এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০১৮ তে বর্ণিত স্ট্যাফিং প্যাটার্নটি অনুসরণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রিকুইজিশন নিয়ে আরেক দফা শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ দিন। উল্লেখিত জনবল কাঠামোয় বর্ণিত স্ট্যাফিং প্যাটার্ন অনুসরণ করে নিয়োগ সম্পন্ন করা গেলে আমাদের শিক্ষার দুর্দিন ঘুচে যাবে।
সর্বোপরি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তার আগে সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় তাদেরও বাড়ি ভাড়া প্রদান করতে হবে। কেননা, বাসস্থান যে কোনো মানুষের মৌলিক একটি অধিকার। মাত্র এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একটি মৌলিক অধিকারকে চরম অবহেলা করা হয় সে কথাটি কর্তা ব্যক্তিদের ভেবে দেখা উচিৎ। তা না হলে আমরা মেধাবীদের শিক্ষকতায় টেনে আনতে পারলেও বেশি দিন ধরে রাখতে পারবো না।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।