রাজশাহী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে লোকবল সংকট। ফলে মানসম্পন্ন কাঙ্ক্ষিত প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না এখানকার প্রশিক্ষণার্থীরা।
টিটিসি সূত্রে জানা যায়, অনুমোদিত জনবল কাঠামো অনুযায়ী এখানে সব মিলিয়ে পদ রয়েছে ১১৭টি। অথচ এর বিপরীতে কর্মরত ৮৭ জন। উপাধ্যক্ষ পদ খালি পড়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। এছাড়া ছয়টি চিফ ইনস্ট্রাক্টর পদের তিনটি শূন্য তিন বছর ধরে। প্রায় আড়াই বছর ধরে খালি পড়ে আছে সাত জন সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টরের পদ। শূন্য আটটি ইনস্ট্রাক্টরের পদও।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত প্রশিক্ষকদের একটি বড় অংশের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আফছার উদ্দিন ভুঁইয়া ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। অথচ তিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্ল্যাম্বিং অ্যান্ড পাইপ ফিটিং ট্রেডে। তার স্ত্রী ফারহানা বীথি এ ট্রেডের চিফ ইনস্ট্রাক্টর। তিনি এখানে কাজ করছেন ট্রেড কোর্সের সনদ নিয়ে। একই ট্রেডের ইনস্ট্রাক্টর নাজিম উদ্দিন আহমেদ আল সিরাজী মেকানিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী।
এদিকে কম্পিউটার ট্রেডের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আফজালুল হক প্রামাণিকের একাডেমিক যোগ্যতা ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা। রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং ট্রেডের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আতাউর রহমান পাওয়ার অটোমোটিভ টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। এ ট্রেডের ইনস্ট্রাক্টর হুমায়ুন কবির ও গোলাম সারওয়ার হোসেনও একই ডিগ্রিধারী।
গার্মেন্টস ট্রেডের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ওয়ালিউর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ। তিনিও ট্রেড কোর্স সনদে চাকরি করছেন। অভিযোগ রয়েছে, এ প্রশিক্ষক নিজেই ঠিকভাবে কাপড়ের কাটিং জানেন না। এজন্য তিনি বাইরে থেকে কাটিং মাস্টার নিয়ে আসেন।
এভাবে শুধু ট্রেড কোর্স সনদ দিয়ে ইনস্ট্রাক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন আরো অন্তত সাতজন। এদের মধ্যে কয়েকজন ব্লক ও বাটিক কোর্সের প্রশিক্ষক। যদিও এখানে ওই ট্রেড চালু নেই। তার পরও অন্য টিটিসি থেকে তারা এখানে বদলি হয়ে এসেছেন।
শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অদক্ষ প্রশিক্ষকদের অধিকাংশই শ্রেণীকক্ষে সময় দেন না। অনেকেরই আলাদা ব্যবসা ও চাকরি রয়েছে। যেমন, নগরীর লক্ষ্মীপুরে এখানকার সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ওয়ালিউর রহমানের ওষুধের দোকান রয়েছে। রাজশাহী সার্জিক্যাল নামের ওই দোকানেই সময় দেন তিনি। এছাড়া সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আতাউর রহমান নগরীর বাটারমোড় এলাকার ডেভেলপার কোম্পানি হিমালায় হাউজিংয়ে চাকরি করেন। তিনিও এখানে প্রতিষ্ঠান চলাকালে সময় দেন।
এছাড়া সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ডিজিটাল হাজিরা চালু ও সিসি ক্যামেরা সংযোজন হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন অনেক শিক্ষক। সর্বশেষ গত ১৯ সেপ্টেম্বর আফছার উদ্দিন ভুঁইয়াকে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় সতর্ক করা হয়। প্রতিষ্ঠানে বসে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোয় কৈফিয়ত দিতে বলা হয় ইনস্ট্রাক্টর রেজাউল করিমকে।
এদিকে অনিয়মের কারণে বেশ কয়েকবার অভিযুক্ত প্রশিক্ষকদের সতর্ক করার পাশাপাশি কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ। তবে এতে কাজ তো হয়নি, উল্টো অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন দপ্তরে নামে-বেনামে অভিযোগ দিয়েছেন।
সর্বশেষ গত রোববার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে জনশক্তি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির প্যাডে ২৫ দফা লিখিত অভিযোগ দেয়া হয় জেলা প্রশাসককে। সমিতির টিটিসি আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর আতাউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ইনস্ট্রাক্টর নাজিম উদ্দিনের উদ্যোগে এ অভিযোগ দেয়া হয়। তবে এ অভিযোগে স্বাক্ষরকারী ৪৭ শিক্ষক-কর্মচারী চাপে পড়ে স্বাক্ষর করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারীরা স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর দিয়েছেন বলে দাবি আতাউর রহমানের।
এদিকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়ার বিষয়ে এক সভায় নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে নন-গেজেটেড সরকারি কর্মচারী সমিতি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে কর্মচারীদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মাহবুবুর রশিদ তালুকদার বলেন, কতিপয় শিক্ষক অনিয়ম করে যাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। এ নিয়ে বারবার তাদের সতর্ক করা হয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিসও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সন্তোষজনক জবাব না দিয়ে বিশৃঙ্খলা শুরু করেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
প্রশিক্ষকদের দক্ষতার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, এখানকার শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন। হয়তো শুরুতেই তাদের যোগ্যতার বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে পর্যায়ক্রমে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিচালনা) ড. নূরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ শিগগিরই তদন্ত করবে। দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তিনি।
রাজশাহী টিটিসিতে ভোকেশনাল ১২টি ট্রেডে আসন সংখ্যা ৩৭০। এছাড়া ২৩ ট্রেডে চলছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রত্যেক সেশনে আসন সংখ্যা সব মিলিয়ে ৯১০টি। প্রশিক্ষণার্থীদের একটি বড় অংশ অবহেলিত ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য। বৃত্তির মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা